‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ’

Faridpur Protidin
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশের সময়: রবিবার, ১৫ জুন, ২০২৫ । ১১:৪৬ এএম

মধ্যপ্রাচ্যের আকাশে আবারও ধ্বংসের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হইয়া উঠিয়াছে। ইসরাইল ইরানের উপর বিমান হামলা চালাইয়াছে এবং ইরান পালটা প্রতিশোধের হুঁশিয়ারি দিয়াছে। যুদ্ধের নূতন এই পর্ব শুধু ইরান ও ইসরাইলের জন্য নহে, বরং সমগ্র বিশ্বের জন্য এক গা-ছমছমে অশনিসঙ্কেত। ২০০১ সালে টইন টাওয়ার ধ্বংসের পর হইতে বিশ্ব একটি বারের জন্যও স্থির শান্তি দেখিতে পায় নাই। আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, গাজা, ইয়েমেন, ইউক্রেন-সকল স্থানেই যেন মৃত্যু ও দুর্দশা নিত্যদিনের বাস্তবতা হইয়া উঠিয়াছে। আজকের এই সংঘাত সেই দুঃসহ ধারাবাহিকতারই নির্মম সংযোজন।

ইসরাইলের এই আকস্মিক হামলায় ইরানের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা, পরমাণু বিজ্ঞানীসহ বহুজন প্রাণ হারাইয়াছেন। ইরান তাহার আকাশপথ বন্ধ করিয়া দিয়া বলিয়াছে, যুদ্ধ এখন শুধু আশঙ্কা নহে-বরং এক চলমান বাস্তবতা। অনেকেই মনে করিতেছেন, ইরানে এই নূতন হামলা গোটা অঞ্চলের স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ঠেলিয়া দিয়াছে। অনেক বিশ্লেষকই প্রশ্ন তুলিয়াছেন, এই যুদ্ধ কি আদৌ পরমাণু অস্ত্র নির্মাণ প্রতিরোধের জন্য? না কি ইহা ভূরাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের এক নির্মম খেলা? এই যুদ্ধে শুধু দুইটি দেশের বিষয় নহে, ইহাতে পরোক্ষভাবে অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হইবে তৃতীয় বিশ্বের অসংখ্য দেশ।

তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহের অবস্থা এমনিতেই নাজুক। ইতিমধ্যেই কোভিড-১৯-এর অভিঘাত, ইউক্রেন যুদ্ধজনিত জ্বালানি মূল্যবৃদ্ধি এবং খাদ্য সরবরাহে বিঘ্ন ইহাদের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে নাড়াইয়া দিয়াছিল। এই নূতন সংঘাত তেলের বাজারকে পুনরায় অস্থির করিয়া তুলিবে, বিশ্ববাজারে মূল্যস্ফীতি ঘটাইবে এবং দাতা সংস্থাগুলির মনোযোগ আরো একবার পশ্চিমা কৌশলগত এলাকায় কেন্দ্রীভূত হইবে। আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চল তথা উন্নয়নশীল দেশসমূহ নূতন সংকটে পতিত হইবে।

অনেকেই মনে করেন, এই যুদ্ধ শুধু অস্ত্রের নহে, তথ্য ও মতামতেরও যুদ্ধ। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে যুদ্ধের পক্ষে যুক্তি তৈরির চেষ্টা চলিতেছে। ‘প্রতিরক্ষার স্বার্থে’ বা ‘সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান’ বলিয়া যাহা ব্যাখ্যা করা হইতেছে, তাহার পিছনে রহিয়াছে ভিন্ন সমীকরণ। সেইখানে রহিয়াছে বাণিজ্যিক স্বার্থ, সামরিক সরঞ্জামের বাজার সম্প্রসারণ এবং ভূরাজনীতিতে একচ্ছত্র আধিপত্য স্থাপনের আকাঙ্ক্ষা। আর এই সকল কিছুর বিনিময়ে জীবন দিতেছে নিরপরাধ শিশু, মা, কৃষক, খেটে খাওয়া মানুষ কিংবা হাসপাতালের নিরপরাধ রোগী।
যুদ্ধ মানে কেবল মৃত্যুই নহে-জীবনের সম্ভাবনাগুলিকেও হত্যা করে। যুদ্ধ মানে শিক্ষার বন্ধন ছিন্ন হইয়া যাওয়া, শৈশবের স্বাভাবিকতা ধ্বংস হওয়া, কৃষিকাজে বিরতি, শিল্পে মন্দা, স্বাস্থ্য খাতে বিপর্যয়। যুদ্ধ মানে শিশুর চোখে ভয় আর ভবিষ্যৎহীনতা। দুঃখজনক হইলেও সত্য যে, মানবজাতি যুদ্ধ ব্যতিরেকে যেন কিছু শিখিতে চাহে না। ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দেয় যে, প্রতিটি যুদ্ধই পরবর্তী যুদ্ধের ভিত্তি রচনা করিয়া যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গঠিত হইয়াছিল জাতিসংঘ, মানবাধিকার ঘোষণাপত্র, বহু আন্তর্জাতিক আইন ও চুক্তি: কিন্তু সেই আইনগুলিকে থোড়াই কেয়ার করে পরাশক্তির দেশসমূহ।

প্রশ্ন হইল, ইহার শেষ কোথায়? ইরান ও ইসরাইলের সংঘাত কি এক বিশ্বযুদ্ধে রূপ লইবে? না কি সময় থাকিতেই বৃহত্তর মানবিক বিবেক জাগ্রত হইবে? বিশ্বের শান্তিপ্রিয় রাষ্ট্রসমূহ কি কেবল উদ্বেগ প্রকাশ করিয়া ক্ষান্ত থাকিবে, না কি সক্রিয় শান্তিরক্ষা উদ্যোগ গ্রহণ করিবে? জীবনানন্দ দাশ সেই কবে বলিয়া গিয়াছেন, ‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ।’ হায়! এই আঁধার কবে দূর হইবে?

© স্বর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। এই ওয়েবসাইটের লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

প্রিন্ট করুন