তৃষ্ণা

Faridpur Protidin
বিশ্বজিৎ চৌধুরী
প্রকাশের সময়: মঙ্গলবার, ১৭ জুন, ২০২৫ । ১২:৪৬ পিএম

এক অনন্ত অনুতাপের ভার বহন করছিলাম আমি। পুকুর ঘাট থেকে কয়েক ধাপ সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এলে যে সিমেন্টের বেঞ্চি, তাতে বসে আছি আমরা দুজন। আমি আর আমার ছেলে। আমার গা ঘেঁষে বসেছে খোকন, আমার একটি আঙুল তার হাতের মুঠোয়। সকালটা সুন্দর, কিন্তু কেমন বিষাদময় ও নিঃশব্দ। তার মধ্যেই হঠাৎ ছোট এক চিলতে খুশির আভা ফুটে উঠল খোকনের ক্লিষ্ট চেহারায়, সে আমাদের গাভিটি ও তার সদ্যোজাত বাচ্চাটিকে দেখিয়ে বলল, ‘বাবা লালিমা।’

গাভিটির নাম লালী। কম বয়সে খোকনকে কেউ পরিচয় করিয়ে দিয়ে হয়তো বলেছে ওর নাম লালী, এটা টুনুর মা। সেই থেকে খোকনের মুখে মা আর লালী মিলেমিশে নামটা হয়ে গেল লালিমা। সেই লালিমার এখনকার বাচ্চাটির নাম টুনু। যা-ই হোক, আমি আপনাদের একটি গাভিবৃত্তান্ত বলতে বসিনি। তার চেয়ে বরং আসল কথায় যাই।

আমার স্ত্রী গর্ভধারণ করার পাঁচ কী ছ মাসের মাথায় আমি একটি ছবি বাঁধাই করে ঘরের দেয়ালে টানিয়েছিলাম। পরিতৃপ্ত চেহারার এক নারীর কোলে স্তন্য পানরত একটি শিশু। খুবই গতানুগতিক একটা ব্যাপার। আসন্ন প্রসবার ঘরের দেয়ালে ফুটফুটে শিশুর (অধিকাংশ ক্ষেত্রে ছেলে শিশু) ছবি আপনারা আকছার দেখে থাকেন। কারণ, একটি স্বাস্থ্যোজ্জ্বল শিশুর হাসিমুখ প্রসূতিকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। মহিলাদের এই দুর্বহ সময়টাও সুখকর হয়ে ওঠে একটি শিশুর মুখ দেখার প্রবল আকাক্সক্ষায়, যেটি তার নিজের শরীরে বেড়ে উঠছে।

দেয়ালে ছবি টানানোর ব্যাপারে আমার আগ্রহকে হাসিমুখে সমর্থন করেছিল আমার স্ত্রী। কিন্তু এমন কোনো বিশেষ মুহূর্তে আমি তাকে দেখিনি, যখন অনিমেষ মুগ্ধ চোখে সে এই ছবিটির দিকে তাকিয়ে থেকেছে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ছবির শিশুটির মতো একটি রূপবান শিশুকে তার কোলে সে কল্পনা করে কি না। উত্তরে সে বলেছিল, না, ঠিক সেভাবে নয়, দেখনদারির চেয়ে সে বরং শারীরিক ত্রুটিহীন একটি স্বাস্থ্যবান সন্তান কামনা করে। শারীরিক ত্রুটির দুশ্চিন্তা তার মাথায় কেন এসেছিল কে জানে!

আমার স্ত্রীর নাম গোধূলি। নামটার মধ্যে কেমন একটা বিষণ্নতা আছে। তার জন্মমুহূর্তের প্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে নামটা রাখা হয়েছিল কি না কে জানে, তবে মেয়ের জন্য এরকম একটা নাম বাছাই করা তার পিতামাতার উচিত হয়নি। আমার কেন যেন মনে হয়, মানুষের জীবনে বা চরিত্রে কোথায় যেন তার নামের একটি প্রভাব পড়ে। এটা আমার কুসংস্কারও হতে পারে। জান্নাতুল ফেরদৌস নামে এক সুন্দরী কিশোরী গায়িকার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল, তার ডাকনাম কান্না। এই নাম শুনে অবাক হয়ে তাকিয়েছিলাম তার দিকে, মনে মনে মেয়েটির মা-বাবার অদ্ভুত মনস্তত্ত্ব বোঝার চেষ্টা করছিলাম। কান্না হেসে নিজেই নিজের নামের কার্যকারণ ব্যাখ্যা করেছিল। তারা চার বোন। তৃতীয় বোনের নাম ছিল আন্না। দুটির পর তৃতীয়বার কন্যা হোক এটি পরিবারের কেউ চায়নি বলেই মেয়ের নাম আন্না, মানে ‘আর না’। চতুর্থবারও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলে সে মেয়ের নাম কান্না না হয়ে আর কীইবা হতে পারে!

গোধূলির ব্যাপারটা মোটেও সে রকম নয়। বরং বাবা ও তিন চাচা-জ্যাঠার যৌথ পরিবারে আটটি পুত্রসন্তানের পর তার জন্ম বলে এই কোল থেকে সেই কোলে ঘুরে বেড়ে উঠেছিল মেয়েটা। নামকরণে সেই আনন্দের প্রকাশ ঘটতে পারত। সমস্যা হয়েছিল অন্য জায়গায়। গোধূলির বাবা ছিলেন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার ও কবি। তিনি জসীমউদ্দীনকে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি গণ্য করতেন এবং প্রায়ই আবেগে কম্পমান কণ্ঠে ‘এইখানে তোর দাদীর কবর …’ বা ‘তুমি যাবে ভাই, যাবে মোর সাথে …’ আবৃত্তি করতেন। সুফিয়া কামালও তাঁর প্রিয় কবি ছিলেন। এহেন কাব্যঅন্তঃপ্রাণ শ্বশুরের আদুরে কন্যাটির পোশাকি নাম যতই নাঈমা আকতার হোক, জন্মলগ্নের সঙ্গে মিলিয়ে তিনি যে নেহাত সাঁঝের মায়া নামে ডাকেননি তাতেই আমাদের সন্তুষ্ট থাকা উচিত।

নাম নিয়ে এত কথা বলার কারণ গোধূলিকে আমি বিয়ের পর থেকে কখনোই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতে দেখিনি। তার অনুচ্চ কণ্ঠস্বর, চাপা ও পরিমিত হাসি এবং প্রায় সর্বক্ষণ মুখে লেপ্টে থাকা গাঢ় বিষণ্নতার অন্য কোনো কারণ খুঁজে না পেয়ে ধরে নিয়েছি মানুষের স্বভাব-চরিত্রের ওপর নামকরণের প্রভাব আছে। যদিও মনোবিজ্ঞানীরা এ-বিষয়ে নীরব।

আমাদের বিয়ে হয়েছিল পারিবারিক যোগাযোগের সূত্রে। মনে পড়ে হবু স্ত্রীকে প্রথমবার দেখেই আমি মুগ্ধ ও কাতর হয়ে পড়েছিলাম। শ্যামাঙ্গীর চেহারায় সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল গাঢ় কাজলে আঁকা বড় বড় বিষণ্ন দুটি চোখ। আমার ধারণা ছিল, বিয়ের পর প্রেমময় উচ্ছ্বাসের তোড়ে এই বিষণ্নতা গাছের ডাল থেকে খসে পড়া পাতার মতো প্রবাহী খালের পানিতে ভেসে যাবে। যায়নি।

‘আমার সংসারে এসে তুমি কি সুখী নও?’ – নাটকে সিনেমায় বহুলশ্রুত এরকম প্রশ্ন বিয়ের প্রথম দিকে যতদূর মনে পড়ে দু-তিনবার তাকে করেছিলাম। প্রতিবারই সে হয় আমার দু-হাত চেপে ধরেছে বা আমার বুকে তার মাথা ঠেকিয়ে নিঃশব্দ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। তখন তার চোখ হয়ে পড়েছিল বাষ্পাচ্ছন্ন। বুঝেছিলাম, ভালোবেসেছে আমাকে, কিন্তু সোৎসাহ প্রকাশের ভাষা তার অনায়াত্ত। ধীরে ধীরে তার অপ্রকাশের ভাষা আর ভালোবাসায় আমি আসক্ত হয়ে পড়েছি।

আমি এমন একটি গ্রামে থাকি, যাকে শহরতলি বলা যায়, আবার মফস্বল বললেও বলা যেতে পারে। এখানকার সদ্য এমপিওভুক্ত একটি কলেজে আমি ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক। গোধূলিও তার বিদ্যোৎসাহী পিতার পরামর্শ বা পরিচর্যায় উচ্চমাধ্যমিক শেষ করেছিল। আমি তাকে অধিকতর বিদ্যা গ্রহণের সুপরামর্শ দিয়েছিলাম। বলেছিলাম বটে, নতুন সংসারে সেই সুযোগ তার প্রায় ছিলই না। বিয়ের অব্যবহিত পর প্রায় বছরখানেক শয্যাশায়ী শাশুড়ির সেবাযত্ন করে, তাঁকে সহি-সালামতে পার করিয়ে দেওয়ার পর যখন একটু হাত-পা ঝাড়া দিতে পেরেছিল, তখন শ্বশুরবাড়ির ছোট সীমানায় কিছু সবজিবাগান করা, দু-চারটে হাঁস-মুরগি বা একটি অন্তত গাভি পোষার ব্যাপার যতটা উৎসাহ তার ছিল, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভের প্রতি ততটা ছিল না। অবশ্য তাকে বিদ্যাদেবী সরস্বতীর মূর্তিতে প্রতিষ্ঠা করার একরোখা বাসনাও আমার কখনো ছিল না, তার চেয়ে এই যে ছোট সবজির বাগানটি
শিম-টমেটো-আলু-পেঁপেতে উপচে পড়ছে, গাভিটির চেহারার চেকনাই আর বালতি ভরা দুধ – এসব দেখে মনে হয়েছে লক্ষ্মীমন্ত বউইবা মন্দ কী।

গোধূলি ছিল অল্পে খুশি ধরনের মানুষ। এ এক অদ্ভুত বৈপরীত্য! চেহারায় রাজ্যের বিষাদ ভর করলেও ভেতরে ভেতরে সে সংসার নিয়ে ছিল পরিতৃপ্ত। এবার তার একটি সন্তান লাভ হলেই সুখ সম্পর্কে যে-পরিধি সে কল্পনা করেছে তার সীমানায় অন্তত একটি খুঁটি পুঁতে দেওয়া সম্পন্ন হয়।

গোধূলি চেয়েছিল একটি ছেলে। আর এদিকে মায়ের কোলে স্বাস্থ্যবান পুত্র সন্তানের ছবি দেয়ালে টানালেও মনে মনে আমি চেয়েছিলাম একটি কন্যাসন্তান। মেয়ের নাম চন্দ্রিকা, চন্দ্রিমা বা চন্দ্রপ্রভা – এই তিনের যে-কোনো একটি বাছাই করব বলে ঠিক করেও রেখেছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গোধূলির ইচ্ছাই পূর্ণ হয়েছিল। প্রায় ছয়-সাত পাউন্ড ওজনের একটি সুকান্ত পুত্রশিশুর জন্ম দিয়েছিল সে। অথচ সে তার আত্মজের মুখ দেখে যেতে পারল না। তার মতো একটি সুস্থ-সবল ও সুন্দর নারী সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যেতে পারে – এ ছিল অবিশ্বাস্য। চিকিৎসকেরা ঘুণাক্ষরেও কখনো এতটুকু ঝুঁকি বা আশঙ্কার কথা আমাকে বলেননি।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নার্স যখন আমার হাতে সদ্যোজাত বেশ হৃষ্টপুষ্ট ছেলেটিকে তুলে দিলেন আর তাঁর পেছনে দাঁড়ানো নারী চিকিৎসক ঘোষণা করলেন প্রসূতির মৃত্যুসংবাদ, তখন নিজেকে প্রবল ঝোড়ো হাওয়ার মধ্যে বিরাট মাঠের মাঝখানে দাঁড়ানো একটি নিঃসঙ্গ তালগাছ মনে হয়েছিল আমার। প্রচুর ঝড়বৃষ্টি আর একটানা হাওয়ার শব্দে যেন অন্ধ ও বধির হয়ে পড়েছি আমি।

কিছুটা ধাতস্থ হলে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল মৃতদেহের সামনে। আমি সন্তান কোলে নিয়ে গোধূলির নিস্পন্দ দেহের সামনে দাঁড়ালাম। ‘চোখে তার যেন শত-শতাব্দীর নীল অন্ধকার/ স্তন তার করুণ শঙ্খের মতো দুধে আর্দ্র – কবেকার, শঙ্খিনীমালার। এ পৃথিবী একবার পায় তারে পায় না কো আর।’

একদিকে গোধূলির অবসান, অন্যদিকে আমার কোলে আমাদের সন্তান – আমাকে অদ্ভুত দোটানার মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। বৈরাগ্য ও সংসারের দোটানা। কিন্তু গভীর বিষাদ সিন্ধুর কিনারে দাঁড়িয়ে শেষ পর্যন্ত সংসার ও সন্তানেই মতি হলো আমার।

বলা যায়, পাশের বাড়ির একজন বৃদ্ধা আর পেটে-ভাতে চুক্তিতে আমার যৎসামান্য ক্ষেত-খামার সামলানোর কাজে বহাল কিশোরটির পরার্থিতায় আমি খোকনকে (একটি সুন্দর নাম বাছাইয়ের ইচ্ছা বা অবকাশ ছিল না) বড় করে তুলছি। এই ‘বড়’ করে তোলা শব্দটা বোধহয় ওর সম্পর্কে যথার্থ বলা হয় না। কারণ খোকন শরীরে বড় হচ্ছিল, মনটা সমান তালে এগোচ্ছিল না।

দুর্ভাগ্য কখনো একা আসে না – এই আপ্তবাক্য আপনাদের ভালোই জানা আছে। আমার ক্ষেত্রে সেটার যাথার্থ্য প্রমাণিত হলো আরো একবার। চিকিৎসকেরা বললেন, বয়সের তুলনায় তার মানসিক বৃদ্ধি বেশ খানিকটা কম। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী শব্দবন্ধটি আজকাল চিকিৎসকেরা আর ব্যবহার করেন না, বরং ‘মেন্টালি চ্যালেঞ্জড’, ‘স্পেশাল নিড্স চাইল্ড’ ধরনের করুণাপূর্ণ শব্দাবলি উচ্চারণ করেন। কিন্তু তাতে বাস্তবতার বিশেষ হেরফের হয় না। যে পিতা-মাতা বা অভিভাবক এরকম একটি সন্তানকে দেখভাল করেন, তারাই কেবল জানেন প্রকৃতির অদ্ভুত বিরূপ খেয়ালের সঙ্গে কী পরিমাণ বোঝাপড়া করতে হয়!

এগারো-বারো বছর বয়সে প্রাইমারি স্কুলের পাঠ চুকিয়ে হাইস্কুলে পা রাখছে ছেলেমেয়েরা। আমাদের মফস্বল এলাকায়ও ঝাঁক বেঁধে স্কুলে ছুটছে খোকনের বয়সী শিক্ষার্থীরা, তারা প্রতি বছর শ্রেণি টপকাচ্ছে, অথচ অসীম ধৈর্যে আমার নাদুস-নুদুস শিশুটিকে এখনো এ বি সি ডি বা, ক খ গ ঘ শেখানোর নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি আমি। কী আশ্চর্য, বিরক্তিবোধের বদলে তার অসহায়ত্ব যেন আমাকে আরো স্নেহপ্রবণ করে তুলছে তার প্রতি। আপনারা বলবেন, পিতৃহৃদয়! আমিও তাই বলি, পিতৃহৃদয় ছাড়া এই বিশাল বেদনা বহন করার সামর্থ্য আর কার আছে! এই যেমন এক বছর আগেও ঘুমের ভেতর বিছানা ভিজিয়েছে সে। এখন যে ভেজায় না, এটা একটা বড় অর্জন। একজন পিতা বা মাতার জন্য ওই স্পেশাল নিডের শিশুটিকে এই একটি ধাপ পার করানো মানে বিরাট অর্জন। এই অর্জনের পর আপনাকে উৎফুল্ল হতে হবে। আপনার শিশুটি আরো অনেক বাধা কাটিয়ে উঠতে পারবে বলে বিশ^াস করতে হবে।

প্রায়ই দেয়ালে টানানো ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকে আমার ছেলে। কেন যেন সে ধরে নিয়েছে এটা তার মায়ের কোলে তার ছবি। আগে আমাকে জিজ্ঞেস করত, মা কোথায়? আমি তাকে তর্জনী উঁচিয়ে আকাশের দিকে দেখিয়েছি। তাতে নিজের মতো করে কিছু বুঝে নিত বোধহয়, কিছুক্ষণ দেয়ালের ছবিটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকার পর বাইরে গিয়ে একবার আকাশের দিকে তাকাত। এ-দৃশ্য স্বচক্ষে দেখলে আপনারা হয়তো অশ্রুসিক্ত হতেন!

কখনো-সখনো এমনভাবে কথা বলবে, এতটাই স্বাভাবিক ভঙ্গি, তখন আপনার পক্ষে অনুমান করাও দুরূহ হয়ে পড়বে যে, এই ছেলের বোধবুদ্ধিতে কোনো সমস্যা আছে। বরং ওর সমবয়েসি অন্য দশটি ছেলের চেয়ে তখন তাকে অনেক বেশি সপ্রতিভ মনে হয়। যেমন, একদিন আমার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার খারাপ লাগে না বাবা? তোমার যে একটা বউ নাই, তোমার মন খারাপ লাগে না?’

ভেবে দেখুন, যে ছেলের নিজেরই মনের বিকাশ হলো না বয়সের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, সে তার পিতার মনের খবর নিচ্ছে! আমি যে তার প্রশ্নে বিহ্বল হয়ে পড়েছি সেটা বুঝতে না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলাম, ‘তোমারও তো বউ নাই, তোমার কি মন খারাপ লাগে?’

হেসে ফেলল, আমার ইচ্ছাকৃত দুষ্টুমি ধরতে পারার আনন্দে সলজ্জ হাসি, বলল, ‘ছোটদের বউ থাকে না।’

আমার ধারণা, হোসেন নামে যে-ছেলেটির সঙ্গে খোকন দিনের অনেকটা সময় কাটায়, তার কাছে নানা সবক পাচ্ছে ইদানীং। অবশ্য বাচুনির মায়ের কাছেও শুনে থাকতে পারে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘এটা তোমাকে কে বলল?’

‘আমি দেখেছি। ফজল চাচার বউ আছে, মুন্সি চাচার বউ আছে, নুরু মিস্ত্রির বউ আছে … তোমার বউ নাই। তোমার খারাপ লাগে না বাবা?’

একটা দীর্ঘশ্বাস চাপা রেখে বললাম, ‘লাগে।’

খোকন আমার মাথায় হাত বুলাতে লাগল। হয়তো মন খারাপের ওপর একটু ভালো লাগার প্রলেপ বুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। আমার মন খারাপের ব্যাপারটা সে অনুভব করতে পারে। কী করে পারে? তার ভেতরও একটা মন খারাপের সুর বোধহয় মাঝে মাঝেই বেজে ওঠে। ওর বয়েসি ছেলেমেয়েদের সবারই প্রায় মা আছে, ওর কেন নেই – এ নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি বটে, নেই যে সেটা তো বোঝে! মা কোথায় জানতে চেয়েছিল, আমি যে আকাশের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়েছি সেটাও মেনে নিয়েছে। কিন্তু তাকে ছেড়ে সেখানে গেল কেন সেই প্রশ্নটা কখনো করেনি। নিশ্চয় সেই প্রশ্নে অভিমানী করুণ একটা সুর তার মনে বাজে। কী জানি হয়তো বাজে না, ব্যাপারটা সে ওরকম করে হয়তো ভাবেইনি বা ভাবতে শেখেনি। এই বিশেষ শিশুদের সবটা বোঝার তো উপায় নেই।

আমি কলেজে যাওয়ার সময় কখনো বাধা দেয় না। বুঝে নিয়েছে এটাই নিয়ম। দিব্যি বৃদ্ধা বাচুনির মায়ের সঙ্গে থাকে, নতুবা তার চেয়ে বয়সে বছর দু-তিনেকের বড় হোসেনের সঙ্গে এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়ায়। আমি তাদের কিছু নিয়মকানুন ও সতর্কতার কথা জানিয়ে রেখেছি। পুকুরে যেন তাকে কিছুতেই নামতে না দেয়, তা-ও বলে রেখেছি। খোকন বলতে গেলে তার যাবতীয় বুদ্ধির অভাব নিয়েই দিব্যি তার মতো করে হেসেখেলে কাটায়। তবে কলেজ শেষে আমি বাড়ি ফিরে এলে আর কিছুতেই আমার কাছছাড়া হতে চায় না। মাসে-দুমাসে একবার শহরে নিয়ে যাই ক্লিনিকে। মনোচিকিৎসক খোকনের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন। তার সঙ্গে হাসিমুখে গল্পসল্প করেন, প্রতিবারই ফিরে আসার সময় বলেন, ‘দুশ্চিন্তা করবেন না, ছেলের অবস্থা এখন অনেক ইমপ্রুভড।’

আমি ছেলের হাত ধরে আশা-নিরাশায় দুলে বাড়ি ফিরে আসি।

সব এক রকম ঠিকঠাকই চলছিল; কিন্তু ইদানীং হঠাৎ এই ছেলে অদ্ভুত এক বায়না শুরু করেছে। তার একটি মা লাগবে। আপনারা মুচকি হাসছেন, তাহলে তো আমার বেশ একটা হিল্লে হলো! আসলে গোধূলি মারা যাওয়ার পর কবরের মাটি শুকানোরও আগে থেকেই অনেকে আমাকে এ-ব্যাপারে তাগিদ দিয়ে আসছে। তারা এটিকে সামাজিক দায়িত্ব ভাবে। কিন্তু আমার পক্ষে অন্তত একটি জীবন গোধূলিকে ভুলে যাওয়া অসম্ভব নিশ্চিত হয়ে বিবাহ বিষয়টিকে ভাবনায়ও আনিনি। আমার বয়স চল্লিশ পেরোয়নি, দেখতে শুনতে ভালো – এইসব বিবেচনায় রেখে যারা আমাকে উৎসাহ দিতে এসেছিল আমি তাদের নিরস্ত করেছি, অতি-উৎসাহীদের বলতে গেলে রীতিমতো দুর্ব্যবহার করে বাড়ির ত্রিসীমানা থেকে বিদায় করেছি। সুতরাং খোকনের একটি মা নিয়ে আসার আবদার আমাকে ডগমগ করে তুলেছে বলে যারা ভেবেছেন তারা আসলে আমাকে অধিকাংশ পুরুষের মন-মানসিকতা দিয়ে বিচার করেছেন। এটা আমার প্রতি আপনাদের অবিচার।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাকে ঢোঁক গিলতে রাজি হতে হয়েছে। আর সবকিছু আমি উপেক্ষা করতে পারি, আপনারা যাকে বলেন জৈবিক প্রয়োজন তা-ও আমাকে ততটা তাড়িত করতে পারেনি, কিন্তু ছেলের আহাজারি উপেক্ষা করতে পারলাম না।

বাংলাদেশের মেয়েদের, বিশেষত স্বল্পশিক্ষিত গ্রামের মেয়েদের মূল্য-মর্যাদা কম – এ-কথা জানতাম। কিন্তু এতটা খারাপ জানতাম না। মাত্র এক মাসের মধ্যে একজন বিপত্নীক কলেজ শিক্ষকের জন্য অন্তত আধডজন ভালো প্রস্তাব এনে হাজির করেছিলেন আত্মীয়স্বজনেরা। এই মেয়েরাও প্রত্যেকেই আমার একটি মানসিক প্রতিবন্ধী সন্তান সম্পর্কে জানে, এবং এই ‘কঠিন ঝামেলা’ সহ্য করে সংসার করতে হবে, তা-ও জানে। তারপরও তারা সম্মত।

আরেকজন গোধূলিকে তো পাব না, আমি দেখে-শুনে সুশ্রী-সুগঠনা ও শান্ত-স্বভাবের একটি মেয়েকে অতঃপর বিয়ে করেছি। দোজবরে বিয়ে হওয়া মেয়েটি যাতে কিছুতেই মনোকষ্টে না ভোগে সেদিকেও যথেষ্ট মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করেছি আমি। জৈবিক প্রয়োজনের নামে আকারে-ইঙ্গিতে যে যৌনাকাঙ্ক্ষার কথা আপনারা বলতে চেয়েছিলেন, অকপটে স্বীকার করি, সেটাও ফিরে এসেছে পূর্ণোদ্যমে। না আসার কোনো কারণ তো নেই, আমি একজন
সুস্থ-সবল পুরুষ, এরকম একজন পরিপূর্ণ যুবতীর সান্নিধ্যে এলে শরীর তার নিজের ভাষায় কথা বলবেই। হ্যাঁ, প্রথমদিকে দু-একবার গোধূলির সঙ্গে এককালের এরকম বিশেষ মুহূর্তগুলোর স্মৃতি মনকে বিক্ষিপ্ত করেছে, শরীরে এক ধরনের শৈথিল্য বা অবসাদ ভর করেছে। যত যাই হোক, শরীরের ভাষাও মন দিয়েই তো লিখতে হয়! তবে শুরুর ওই দু-একটা দিনই, শেষ পর্যন্ত শরীর-মনের বোঝাপড়া হয়ে গেছে।

এই ব্যাপারটা আমাদের বেশ একটু সতর্কতার সঙ্গেই করতে হয়। খোকন আমাদের সঙ্গে শোয়। ছেলেটা গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলে আমরা বেড়াল-পায়ে পাশের ঘরে যাই। সেখানে আরেকটি বিছানা পাতা আছে। সেখানে শুয়ে আমরা পরস্পরকে টেনে নিই।

আপনাদের কাছে তো আর কিছুই প্রায় আড়াল রইল না, তাই দ্বিধা কাটিয়ে আরেকটা কথা বলেই ফেলি, জেবুন্নেসা, মানে আমার দ্বিতীয় স্ত্রী যৌনতার ব্যাপারে গোধূলির তুলনায় অনেক বেশি আগ্রহী ও আগ্রাসী। পুরো বিছানাজুড়ে হুলস্থূল, মুখে অনর্গল অবোধ্য বা অশ্লীল শব্দের উচ্চারণ করে সে রীতিমতো নরক গুলজার করে তোলে। স্বাভাবিক সময়ে শান্ত-নম্র এ-মেয়েকে দেখে তার এই মূর্তি আপনারা কল্পনাই করতে পারবেন না। তার এই দাপাদাপির জন্য দু-একবার সমস্যায়ও পড়তে হয়েছে। পাশের ঘরে খোকনের ঘুম ভেঙে গেছে। সে একবার ডানে, একবার বাঁয়ে হাত দিয়ে কারো স্পর্শ না পেয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠেছে। আমরা তখন যে অবস্থায়ই থাকি, গুটিয়ে নিয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছি ছেলের পাশে।

আমাদের দুজনের মাঝখানে ঘুমায় খোকন। অনেক বুঝিয়ে-শুনিয়ে তাকে আমার পাশে ঘুমানোর জন্য রাজি করাতে পারিনি, সে নতুন মায়ের পাশেই ঘুমাবে। জেবুন্নেসাকেই বুঝিয়ে রাজি করাতে হয়েছে। জেবুন্নেসা অনিচ্ছায় মেনে নিয়েছিল। কিন্তু ঘুমের ঘোরে প্রায়ই ছেলেটা তার শরীর ঘেঁষে থাকে, এমনকি মুখটা গুঁজে রাখতে চায় বুকের কাছে, এটাতেই তার আপত্তি। এটা নিয়ে বারংবার আমার তাকে বোঝাতে হয়েছে। খোকনের বয়স যা-ই হোক মনের দিক থেকে এখনো তিন-চার বছর পেরোয়নি। তবু অস্বস্তিটা কখনো যায়নি জেবুন্নেসার। ঘুমের ঘোরে প্রায়ই সে ছেলের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্য পাশে শোয়। ভেবেছিলাম ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ঠিক হয়ে যায়নি।

শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা এমন বীভৎস রূপ নেবে ভাবতে পারিনি আমরা কেউই। সেদিন ভোররাতের দিকে প্রচণ্ড ধস্তাধস্তির শব্দে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গিয়েছিল আমার। স্বল্পালোকিত ঘরে যে-দৃশ্য চোখের সামনে দেখলাম তা রীতিমতো অবিশ্বাস্য। জেবুন্নেসার ওপর চড়াও হয়ে দু-হাত চেপে ধরে সে মুখ রেখেছে তার একটি স্তনে। তার আগেই ছিঁড়ে ফেলেছে তার ব্লাউজ। জেবুন্নেসার চোখমুখ ভীতিবিহ্বল।

এতদিনে যেন আমার কাছে দৃশ্যমান হলো ছেলেটা গায়ে-গতরে যথেষ্ট বড় হয়েছে। যথেষ্ট শক্তিও ধরে শরীরে। মুহূর্তে একটা কামার্ত পুরুষ মনে হলো তাকে আমার। পা থেকে মাথা পর্যন্ত সর্বাঙ্গ জ্বলে উঠল। জেবুন্নেসার শরীর থেকে টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে প্রচণ্ড চড় মারলাম গালে। কখনো হাত তুলিনি গায়ে, খোকন সবিস্ময়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কী যে হয়ে গেল আমার। এই নির্বোধের মতো দৃষ্টিটা সহ্য হলো না। জানালায় পর্দা টানানোর একটা সরু লাঠি পেয়েছিলাম হাতের কাছে। সেটা দিয়ে এলোপাতাড়ি পেটাতে শুরু করলাম। যতক্ষণ না জেবুন্নেসা ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার হাত থেকে লাঠিটা কেড়ে নিয়েছে, ততক্ষণ বলতে গেলে হুঁশই ছিল না আমার। কী আশ্চর্য, যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছে, চেহারায় সুস্পষ্ট তার ছাপ, চোখ দিয়ে অনর্গল পানি গড়াচ্ছে, গোঙানির মতো একটা শব্দ বেরোচ্ছে মুখ থেকে, কিন্তু সে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেনি বা হাত দিয়ে মার ঠেকানোর চেষ্টাও করেনি! শুধু তার চোখে জেগে ছিল অপার বিস্ময়! বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীর মনে যে সামান্যটুকু বুদ্ধি, তা দিয়ে হয়তো সে তার বাবাকে বোঝার চেষ্টা করছিল।

ঝড় থেমে যাওয়ার পর গৃহস্থ যেমন তার এলেমেলো বাড়িটিকে গুছিয়ে তোলার চেষ্টা করে, তেমনি ভোরের দিকে জেবুন্নেসা সবকিছু স্বাভাবিক করে নেওয়ার কাজে নেমে পড়েছিল। ছেলেটাকে প্যারাসিটামল ট্যাবলেট খাইয়েছে, শরীরের লাল-কালো হয়ে থাকা প্রহারচিহ্নে বাটা হলুদের প্রলেপ লাগিয়ে দিয়েছে।

আমি বিছানায় পড়ে কাটা মাছের মতো ছটফট করেছিলাম বেশ কিছুক্ষণ। তারপর কখন বেঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছি মনে নেই। ঘুম ভেঙে দেখি, বিছানায় খোকন বসে আছে পাশে, নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে আমার মুখের দিকে। কিন্তু তার দৃষ্টি থেকে ব্যথিত-বিস্ময় তখনো যায়নি।

আমি তাকে নিয়ে বাইরে এলাম। বাইরে তখন অপূর্বসুন্দর একটি সকাল। কাল রাতে একবার বৃষ্টি হয়েছিল, গাছের পত্র-পল্লবে এখনো সেই ভেজা ভাবটা রয়ে গেছে। সূর্যের আলো নরম। আমি খোকনকে নিয়ে পুকুরঘাটের বেঞ্চিতে এসে বসেছি। এখনো তার হাতের মুঠোয় আমার একটি আঙুল। বেশ কিছু নির্বাক মুহূর্ত কাটানোর পর আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি এরকম করলে কেন বাবা?’

সব কথা বুঝতে পারে না, মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি এবার খুব ধীরে এক একটা শব্দ প্রায় আলাদা করে বললাম, ‘মায়ের জামা ছিঁড়ে ফেলেছ কেন? বুকে মুখ দিয়েছ কেন?’

অনেক কষ্টে বোঝাতে পারলাম বোধহয়। মাথা নামিয়ে বলল, ‘আমার তেষ্টা পায় বাবা।’

এ-উত্তর শুনে নতুন কোনো প্রশ্ন খুঁজে পাই না আমি, বুঝে উঠতে পারি না, সত্যি কি তেষ্টা পায়?

হঠাৎ ‘ওই দেখ … ওই দেখ’ – বলে লালীকে দেখিয়ে দেয় খোকন, তার বাছুরটা তখন ঢুঁশ দিয়ে দিয়ে দুধ খাচ্ছিল।

‘টুনুকে কি কেউ মারে বাবা?’ – এই নিরীহ প্রশ্নের পর গো-শাবকের মতো বড় বড় দুটি চোখ তুলে আমার দিকে তাকায় ছেলেটা। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আমার গোধূলিকে মনে পড়ে। সেই বিষণ্ন দুটি চোখ! আমি খোকনকে দু-হাতে বুকে টেনে নিয়ে গোধূলির জন্য ডুক‌রে কেঁদে উঠি।

© স্বর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। এই ওয়েবসাইটের লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

প্রিন্ট করুন