দারিদ্র্যের হার বাড়ছে কেন

Faridpur Protidin
ড. এস এম জাহাঙ্গীর আলম
প্রকাশের সময়: বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০২৫ । ৯:৫২ এএম

অর্থনৈতিক চাপ, যেমন উচ্চ মূল্যস্ফীতি, কর্মসংস্থান হ্রাস এবং উৎপাদনশীলতা কমে যাওয়ার কারণে দারিদ্র্য বাড়ে। এ ছাড়া, অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্য ও শিক্ষার সুযোগ, বৈষম্যমূলক নীতি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং একটি নির্দিষ্ট দারিদ্র্যের চক্রের কারণেও দারিদ্র্য বাড়ে। দারিদ্র্য বাড়ার আরেকটি কারণ হলো উচ্চ মূল্যস্ফীতি। জীবনযাত্রার প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়ার কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়, যা দরিদ্র পরিবারগুলোকে আরও দরিদ্র করে তোলে। এরপর আছে কর্মসংস্থান সংকট। পর্যাপ্ত নতুন কর্মসংস্থান তৈরি না হওয়া এবং মন্দার কারণে চাকরি হারানোর ফলে আয়ের উৎস কমে যায়। অর্থনৈতিক বৈষম্য সুবিধাভোগীরা আরও বেশি সুবিধা পায়, কিন্তু অনেক দরিদ্র ও নিম্ন-আয়ের মানুষ প্রয়োজনীয় পরিষেবা থেকেও বঞ্চিত হয়। সঠিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার অভাবে মানুষ ভালো চাকরি পায় না এবং তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয় না। বন্যা, খরা, ঝড় এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে কৃষি ও কৃষিনির্ভর অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা দারিদ্র্য বাড়িয়ে দেয়। উচ্চ সুদের ঋণ বা অন্যান্য ঋণের জালে আটকা পড়া দারিদ্র্য আরও বাড়িয়ে তোলে। জ্বালানিসংকট, আর্থিক খাতের দুরবস্থা, উচ্চ সুদহার, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, কম হারে মজুরি বৃদ্ধি, ক্রয়ক্ষমতা কম এসব সমস্যা তো অর্থনীতিতে আছেই। তবে বর্তমান সরকারের সময় যুক্ত হওয়া বড় দুটি উপাদান হচ্ছে অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা। এতে তৈরি হয়েছে আস্থাহীনতা। এ কারণে অর্থনীতি গতিহীন, বিনিয়োগ নেই, হয়নি বাড়তি কর্মসংস্থান। ফলে অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধিও সামান্য।

সাম্প্রতিক তথ্যানুসারে, ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে বেকার জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১ লাখ ৬০ হাজার বেড়ে ২৬ লাখ ২০ হাজারে দাঁড়িয়েছে। বেকারত্ব বৃদ্ধির কারণ হিসেবে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বিনিয়োগের পরিবেশের অভাব এবং ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহারকে দায়ী করা যায়। বেকার জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ২০২৩ সালে ২৪ লাখ ৬০ হাজার থেকে বেড়ে ২০২৪ সালে ২৬ লাখ ২০ হাজার হয়েছে। বেকারত্বের হার ২০২৪ সালে সার্বিক বেকারত্বের হার ৪.৪৮ শতাংশ। এটি ২০২৩ সালের ৪.১৫ শতাংশ থেকে বেশি। অন্যদিকে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে।

উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ না থাকা এবং ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদের হার বেকারত্ব বৃদ্ধির প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ১৩তম আইসিএলএসের ভিত্তিতে বিবিএসের সর্বশেষ ত্রৈমাসিক জরিপ অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর শেষে দেশের শ্রমশক্তি ছিল ৭ কোটি ৬ লাখ নারী-পুরুষ। জরিপের সময় দেশে ৬ কোটি ৭৫ লাখ ১০ হাজার নারী-পুরুষ আগের সাত দিনে এক ঘণ্টা মজুরির বিনিময়ে কাজ করেছে। অর্থাৎ, তারা কর্মে নিয়োজিত হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এর মধ্যে পুরুষ ৪ কোটি ৫৭ লাখ ৭০ হাজার এবং নারী ২ কোটি ১৭ লাখ ৪০ হাজার। যারা কর্মে নিয়োজিত নয় কিন্তু বেকার হিসেবেও বিবেচিত নয়, তারাই মূলত শ্রমশক্তির বাইরের জনগোষ্ঠী। এ জনগোষ্ঠীতে আছে শিক্ষার্থী, অসুস্থ ব্যক্তি, বয়স্ক, কাজ করতে অক্ষম, অবসরপ্রাপ্ত এবং কর্মে নিয়োজিত নয় বা নিয়োজিত হতে অনিচ্ছুক এমন গৃহিণীরা।

উল্লেখ্য, প্রতি বছর কমপক্ষে ২০ লাখ মানুষ চাকরির বাজারে প্রবেশ করে। তাদের মধ্যে ১৩-১৪ লাখ মানুষের দেশের অভ্যন্তরে কর্মসংস্থান হয়। বাকিরা কাজের জন্য প্রবাসে যায়। তাই দুই দশক ধরে বেকারের সংখ্যা মোটামুটি ২৪-২৮ লাখের মধ্যেই রয়েছে।

বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ৭৩৮ মার্কিন ডলার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চূড়ান্ত হিসাবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এ তথ্য দিয়েছে। এ হিসাবে সাময়িক হিসাব থেকে মাথাপিছু আয় ৪৬ ডলার কমে গেছে। সাময়িক হিসাবে মাথাপিছু আয় ছিল ২ হাজার ৭৮৪ ডলার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মাথাপিছু আয়, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) চূড়ান্ত হিসাব দিয়েছে। সেখানে এ তথ্য পাওয়া গেছে। এ হিসাবে দেখা গেছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারও কমেছে। এক বছরে বেকার বেড়েছে দেড় লাখ। ২০২৫ চূড়ান্ত হিসাবমতে, দেশে বেকার জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ২৬ লাখ ২০ হাজার। ২০২৩ সালে এটি ছিল ২৪ লাখ ৬০ হাজার। দেশে তিন মাসে বেকার বেড়েছে ৬০ হাজার। ২০২৫ সব মিলিয়ে এক বছরের ব্যবধানেও দেশে বেকার বেড়েছে। ২০২৪ সালে দেশে বেকারত্বের হার ছিল ৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ। দারিদ্র্য হ্রাসে বাংলাদেশ সাফল্য দেখালেও ২০১৬ সাল থেকে দারিদ্র্য কমার গতি ধীর হয়েছে। এ সময় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলেও সেটি তুলনামূলক কম অন্তর্ভুক্তিমূলক। ফলে প্রবৃদ্ধির সুফল পেয়েছে ধনী মানুষরা। বর্তমানে দেশের নতুন কর্মসংস্থান তৈরি একেবারে স্থবির হয়ে গেছে বলে উল্লেখ করেছে বিশ্বব্যাংক। এর ফলে দেশের তরুণ-তরুণীদের মধ্যে যারা কর্মসংস্থানে রয়েছে, তাদের প্রায় অর্ধেক কম মজুরিতে কাজ করছে।

‘বাংলাদেশের দারিদ্র্য ও বৈষম্য মূল্যায়ন ২০২৫’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক এ তথ্য উল্লেখ করেছে। এতে আরও বলা হয়েছে, ২০১০ থেকে ২০২২ সময়ে চরম দারিদ্র্য ১২ দশমিক ২ শতাংশ থেকে কমে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ এবং মাঝারি দারিদ্র্য ৩৭ দশমিক ১ শতাংশ থেকে কমে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। তবে প্রায় ৬ কোটি ২০ লাখ মানুষ যা মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ, অসুস্থতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা অন্য যে কোনো অপ্রত্যাশিত বিপর্যয়ের মুখে পড়ে আবারও দারিদ্র্য সীমার নিচে নেমে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়ে গেছে। সম্প্রতি প্রকাশিত এ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, প্রবৃদ্ধির সুফল পেয়েছে ধনী মানুষরা, ফলে আয়বৈষম্য বেড়ে গেছে।

প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক বলছে, ২০১০ থেকে ২০২২—এ সময়ে বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে দারিদ্র্য হ্রাস করেছে।

ফলে ২ কোটি ২০ লাখ মানুষ দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে এসেছে এবং আরও ৯০ লাখ মানুষ অতি দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে এসেছে। তাদের জীবনমানের উন্নতি হয়েছে, বিদ্যুৎ, শিক্ষা, পয়ঃনিষ্কাশনের মতো জরুরি সেবাগুলো পাওয়া সহজ হয়েছে। তবে ২০১৬ সাল থেকে দারিদ্র্য কমার গতি ধীর হয়েছে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও কম অন্তর্ভুক্তিমূলক হচ্ছে। ২০১৬ সালের পর থেকে তুলনামূলকভাবে কম অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতিপথ বদলে গেছে। দেখা গেছে, প্রবৃদ্ধির সুফল পেয়েছে ধনী মানুষরা, ফলে আয়বৈষম্য বেড়ে গেছে। কৃষির ওপর ভর করে গ্রামীণ এলাকাগুলো দারিদ্র্য হ্রাসে নেতৃত্বের ভূমিকায় চলে গেছে। একই সময়ে শহরে দারিদ্র্য হ্রাসের হার কমেছে। অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং টেকসই প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে চাইলে সবচেয়ে জরুরি হবে দারিদ্র্যবান্ধব, জলবায়ু-সহিষ্ণু এবং কর্মসংস্থানকেন্দ্রিক কৌশল গ্রহণ।’

লাখ লাখ বাংলাদেশির জন্য দরিদ্র অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার একটি মাধ্যম অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক অভিবাসন। প্রবাস আয় দারিদ্র্য কমাতে সহায়তা করেছে, তুলনামূলকভাবে গরিব পরিবার এটা থেকে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়। কিন্তু দেশে অভিবাসী হওয়া কর্মীরা শহরের ঘিঞ্জি এলাকায় জীবনযাপন করে, যেখানে জীবনযাত্রার মান নিম্ন। আর সচ্ছল পরিবার ছাড়া আন্তর্জাতিক অভিবাসনের সুযোগ নেওয়া যায় না, কেননা বিদেশ যাওয়ার খরচ খুবই বেশি।

যদিও বাংলাদেশে সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বেড়েছে তবে সেখানে অদক্ষ ব্যবস্থাপনা রয়েছে এবং উপকারভোগী নির্বাচন লক্ষ্যভিত্তিক নয়। দেখা গেছে, ২০২২ সালে সামাজিক সুরক্ষার সুবিধা পাওয়াদের মধ্যে ৩৫ শতাংশই ধনী পরিবার যেখানে অতি দরিদ্র পরিবারের অর্ধেকও এই সুবিধা পায়নি। তা ছাড়া, ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ বেশিরভাগ সময়েই লক্ষ্যভিত্তিক হয় না, এমনকি বিদ্যুৎ, জ্বালানি এবং সারে সরকার যে ভর্তুকি দেয়; তার সিংহভাগ অপেক্ষাকৃত ধনী পরিবারগুলো পায়।

দারিদ্র্য এবং বৈষম্য কমাতে সহায়ক হবে এমন চারটি প্রধান নীতিগত করণীয় চিহ্নিত করেছে এ প্রতিবেদন। এগুলো হলো—উৎপাদনশীল খাতে কর্মসংস্থানের ভিত্তি মজবুত করা, দরিদ্র এবং ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর জন্য বেশি করে শোভন কাজের ব্যবস্থা করা, আধুনিক প্রক্রিয়াজাত শিল্পে বিনিয়োগ ও ব্যবসা-সহায়ক বিধিবিধান তৈরি করে দরিদ্রবান্ধব বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং শক্তিশালী রাজস্ব নীতি ও কার্যকর এবং লক্ষ্যভিত্তিক সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির মাধ্যমে ঝুঁকি মোকাবিলার সক্ষমতা শক্তিশালী করা।

বিশ্বব্যাংকের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ এবং প্রতিবেদনটির অন্যতম লেখক সার্জিও অলিভিয়েরি বলেন, ‘বাংলাদেশ আঞ্চলিক বৈষম্য, বিশেষ করে পূর্ব-পশ্চিমের বৈষম্য বেশ কমিয়েছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি আঞ্চলিক বৈষম্য, বিশেষ করে শহর ও গ্রামের বৈষম্য বাড়িয়ে দিচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দারিদ্র্য মূল্যায়ন দেখিয়েছে যে, উদ্ভাবনী নীতি গ্রহণ, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি, শহরে গুণগত কর্মসংস্থান সৃষ্টি, কৃষিতে দরিদ্রবান্ধব মূল্য-শৃঙ্খল নিশ্চিত করা এবং কার্যকর সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির মাধ্যমে বাংলাদেশ দারিদ্র্য হ্রাসের গতি পুনরুদ্ধার ও ত্বরান্বিত করতে পারে এবং সমৃদ্ধিতে সবার অংশীদারত্ব নিশ্চিত করতে পারে।’

লেখক: সাবেক কর কমিশনার ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান-ন্যাশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন

© স্বর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। এই ওয়েবসাইটের লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

প্রিন্ট করুন