ফরিদপুরে ট্রাক-মোটরসাইকেল-অটোরিক্সার ত্রিমুখী সংঘর্ষে দুইজন নিহত

শীতল বাতাসটা মাঠ থেকে এসে থেকে থেকে ঝটকা মারে। গাছের মগডালে পাখির ডাক মনটাকে উত্তুঙ্গ হাওয়ায় দোলাতে দোলাতে কোথায় যেন নিয়ে যেতে চায়। এমন সময় হারানো স্মৃতিরা ফিরে আসে। গ্রামে তাদের প্রতিপত্তি নেই বললেই চলে। পাড়ার মেয়েদের সঙ্গে হেসেখেলে বেড়ে ওঠা। স্কুলে যাওয়ার বালাই ছিল না। মায়ের জোড়াজুড়িতে পাড়ার মক্তবে আমসিপারা পড়েছে কিছুদিন। তাও বেশিদিন পড়তে পারেনি। সবই নসিব। নসিবে না থাকলে মেয়েলোকের কপালে কিছু হয় না। এ-কথা, সে-কথা, সে কত কথা যে শুনেছে তার ইয়ত্তা নেই! আসলে এটাই সত্যি। মেয়েমানুষ যেখানেই যাবে, সেখানেই পিছে শত্রু লাগে। ‘মেয়েমানুষের শরীরডা হইলো এক্কেবারে পচা’ – জীবনে এটাই জেনেছে ফুলবানু। পদে পদে হরিণের মতোই বেগতিক অবস্থা। শিকারির নজর রক্ত-মাংসের হরিণীর ওপর। সেই বিপদ থেকে টেনেটুনে এ পর্যন্ত এনেছে সে। জানে না, সে আর কতদূর এগোতে পারবে। এখনো সে বিপদের মধ্যেই বসবাস করে।
তো সেই মক্তবে মুনশি হুজুর ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকত তার দিকে। তার ভয় লাগত। শুধু এইটুকু হলে সারা যেত। পড়া বুঝিয়ে দিতে এসে পেছনদিকে কেমন সুড়সুড়ি দিত। এটা ফুলের ভালো লাগত না। কারণ হুজুরের দাড়ির জঙ্গল পিঠের ওপর খোঁচা মারতো। গা থেকে আতরের বিটকেলে গন্ধে দম বন্ধ হয়ে যেত। আবার হুজুর হাতটাও কেমন চেপে চেপে ধরে রাখতো। ফুলের নারীমনটা বুঝে গিয়েছিল। হুজুর সুবিধার না। তাই মায়ের কাছে ঘ্যানোর ঘ্যানোর করতো, সে আর পড়তে যাবে না। আসল কারণ বললে কেউ বিশ্বাস করবে না। আবার ওসব কথা বললে পিঠের ছাল তুলে নেবে। কারণ একই সমস্যার কথা আরেকটি মেয়ে বলতে গিয়ে কী দশা হয়েছে, ফুল দেখেছে। ওই মেয়ের পড়া বন্ধ। অনেক পিটুনি খেয়েছে মা-বাবার কাছ থেকে। আর এখন তো ওই মেয়েটা রাস্তাঘাটেই বের হতে পারে না। সবাই ওকে পাকনা মেয়ে বলে ডাকে। ওই মেয়েটা কী করবে বেদিশা হয়ে গেছে।
ফুল প্রায় দিন আমসিপারা নিয়ে নদীর ধারে চলে যেত। ছুটির সময় হলে ফিরে আসত। মা একদিন চালাকি ধরতে পেরে বলল, ‘ঠিক আছে তর আর পড়ন লাগব না। তুই আজীবন মূর্খই থাক। হারামজাদি আমারে বোকা বানাস। এখনি ধোঁকা দিওন শিখ্খা গেছস। জীবন তো এহনো পইড়া রইছে।’ সেই থেকে মক্তবের পড়া ফুলের শেষ। এরপর ঘরে বইসা বইসা তো খাওন দিব না মায়ে। কামকাইজ করতেই হইব।
এরপর গ্রামের এক বাড়িতে ঘুঁটে বানানোর কাজে লাগিয়ে দিলো মা। বসে বসে ঘুঁটে বানাতে পা ধরে যেত। গোবর-ভুসিতে গুলিয়ে পাটকাঠিতে জড়িয়ে খালপাড়ে শুকাতে দিতে হতো। এটাও ফুলের কাছে বিরক্তিকর কাজ। মাঝে মাঝে মেয়েদের সঙ্গে খাল পেরিয়ে মাঠে চলে যেত। ধানক্ষেতের নিড়ানিদের সঙ্গে বসে সেও গল্পগুজব করত। কিন্তু সেটাতেও বাদ সাধল মা। ঘুঁটেওয়ালারা এসে অভিযোগ দিলো, ‘তোমার মেয়া কামকাইজ করে না। অন্য মানুষের লগে আড্ডা দেয়।’
সব শুনে মা দিলো ঝাঁটাপিটুনি। পাশের বাড়ির খালা দৌড়ে এসে ধরল। বলল, ‘আরে করো কি, করো কি! মেয়ে ডাঙ্গর হইছে না, এমুন কইরা মারলে কি আর জাইত থাকে? দুইদিন পর যাইব পরের বাড়ি। সেইখানেও তো লাত্থিগুঁতাই খাইব। অমন কইরা মাইয়াগো মারতে নাই।’
মা জবাব দিলো, ‘স্বভাব ভালা না হইলে লাত্থিগুঁতাই মিলব ওর কপালে।’ ঘরে আরো দুটো বোন আছে ফুলের। ওগুলোও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। অবশ্য এটা তার মায়ের কথা। খাওনের পেট বাড়ে, আয়ের রাস্তা বাড়ে না। বাপটা ভাদাইম্যা। সারাদিন কই কই থাকে, ঠিক থাকে না। নিজের পেট ভরলেই ঠিক আছে। অন্যের পেটের খবর বাপটা তেমন রাখে না বললেই চলে।
ফুলের ইচ্ছা করে মাঝেমধ্যে বাপের ভ্যানটা নিয়ে রাস্তায় চালায়। কিন্তু মা শুনলে আর আস্ত রাখবে না। আর গ্রামের মানুষই বা কি ভাববে। ঢিঢি পড়ে যাবে গ্রামে। বলবে, ফুলবানু মর্দা মানুষের মতো কাজ করে। বদনাম ছড়িয়ে যাবে চারদিকে। অথচ ভ্যান চালানো ঝমেলা ছাড়া ইনকাম। ভ্যান চালিয়ে ইনকাম করলে সংসারে কিছু আয়-রোজগার হতো। কিন্তু মায় দেখলে আর বাঁচন নাই। ভ্যান চালানি বাইর কইরা দিব। আর এমুন কাম করলে কেউ বিয়ের জন্য আসবেও না। এসবের মধ্যে দিয়েই ফুলবানু শোনে একদিন, তার বিয়ে হবে।
দুই
মনে মনে ভাবল ফুলবানু। ঠিকই আছে। এত জঞ্জালের চেয়ে বিয়ে হয়ে গেলেই ভালো। এদিক থেকে ও খামচা মারে, ওদিক থেকে ও টান মারে, ব্যাপারটা কেমন জানি ঠেকে ফুলের কাছে। কিন্তু এর মধ্যেও মাতুব্বরের ছেলে ফুলের চোখে রং ধরাতে চায়। আড়েঠাড়ে কী বলে, ফুল ঠিক বোঝে না। সবাই বলে ছেলেটা বাটপার। কিন্তু ফুলের রঙিন চোখে ওকে কেন জানি ভালোই লাগে। ইচ্ছা করে ওর সঙ্গেই হাত ধরে কোথাও চলে যায়। কিন্তু পাড়ার অন্য মেয়েরা বলছে, ‘মাতুব্বরের ছেলে একটা টাউট। ওই হগলের লগেই লাইন খেলে। সুবিধা লয়। ওই কারো বিয়া করবো না।’
এমন কথা শোনার পর ফুলের বুকটা ধুকপুক করে। এদিকে তার বিয়ের কথা যে-ছেলেটার সঙ্গে চলছে, তাকেও সে আড়াল থেকে দেখেছে। দেখতে-শুনতে ভালোই। জোয়ানকি আছে ছেলের। তবে মনে হয়েছে তার বাপটা জানি কেমন কেমন। কনে দেখতে এসে বাপটাও কেমন করে ফুলের দিকে তাকিয়ে ছিল। ব্যাপারটা মোটেও ভালো লাগেনি ফুলের। কিন্তু এসব ভালোটালো লাগা দিয়ে ফুলের কিছু হবে না। এসব কথা বললে, মা গরম খুন্তি দিয়ে পিঠে ছ্যাঁকা দেবে। তার চেয়ে যা আছে কপালে, বিয়ে করে এই বাড়ি থেকে চলে যেতে পারলেই ভালো।
তারপরে যে দুটো বোন আছে, ওদের দায়িত্বও তো মাকেই নিতে হবে। মামারা আর কত টানবে ওদের পরিবার। কিছু হলেই তো বাপটা চিল্লাবে। মায়ের ভাইদের নিয়ে আকথা-কুকথা বলবে। বিপদকালে সেই ভাইদেরই কাজে লাগে বলে, মা আর কত গজর গজর করবে? তার চেয়ে ফুলের বিয়ে হয়ে যাওয়াই মঙ্গল।
অথচ ফুলের ইচ্ছা ছিল একটু লেখাপড়া শিখবে। তারপর শাফিয়ার মতো ঢাকায় গিয়ে গার্মেন্টে কাজ নেবে। শাফিয়া এখন ঈদে-পার্বণে বাড়িতে কত টাকা দেয়। শাফিয়া গ্রামের ইশকুলে পাঁচ কেলাস পড়েছে। কথায় কথায় সে শাফিয়াকে বলেছিল, ‘বুবু আমারে ঢাকায় নিয়া যাও। তোমার মতো একটা চাকরি-বাকরি জুটাইয়া দাও। আমার গ্রামে ভালা লাগে না। এইহানে হগলেই খালি আকথা-কুকথা কয়। আর বুড়া শকুনগুলান গায়ে হাত দেয়।’
শাফিয়া হেসে বলেছিল। ‘এই অবস্থা হগল জায়গাইরে বইন। এ থাইকা মরণের আগ পর্যন্ত নিস্তার নাই।’
‘আইচ্ছা বুবু ঢাকা শহরে মানুষের সময় আছে বুঝি এত কিছু দেহনের? হগলেই দৌড়াইতেছে টাকার পেছনে, তাই না?’
শাফিয়া হাসে। ‘বুঝছি তুই আর গ্রামে থাকবি না। তাই না?’
‘হ বুবু, আমারে লইয়া যাও। আমার মনডা খালি ছডফডায়। এইহানে আর পরান টিকে না। আমিও তোমার মতো টেহা কামাইতে চাই। বাড়িতে যহন তোমার মতো আসমু, তহন তোমার মতো আমারেও কত আদর-যত্ন করবো মায়। এহন তো হুদা মিছাই মায় গাইল পারে আর গাইল পারে। যহন-তহন ঝাঁডা দিয়া মারে। আবার গরম খুন্তি দিয়াও ছ্যাঁকা দেয়।’
শাফিয়া চুপ করে শোনে ফুলের কথা। মনে হয়, সে সব বুঝতে পেরেছে। তখন সে বলে, ‘ঠিক আছে। আমি আগামীবার আইলে তরে লইয়া যামু। গার্মেন্টে ম্যানেজাররে সব কইয়া তর লাইগা ঠিকঠাক কইরা আমু। তুই চাচিরে কইয়া রাখিস কইলাম।’
‘হেই কথা আর তোমারে কইতে হইব না। আমি সব কইয়া ঠিক কইরা রাখুম।’
ফুল সবই ঠিক করে রেখেছিল মাকে বলে। কিন্তু বিধি বাম, ফুলের আর ঢাকায় গার্মেন্টে চাকরি করতে যাওয়া হয় না। তার আগেই তার বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। আর শাফিয়ারও আসতে ঢের সময় বাকি। ফুলের স্বপ্ন মুখ থুবড়ে পড়ে।
বিয়ের আর মাত্র কিছুদিন বাকি। এর মধ্যেও ফুলের পেছনে লেগে থাকে মাতুব্বরের ছেলে। প্রতিদিন ফুঁসলায়। কুপ্রস্তাব দেয়। এটা-সেটা নিয়ে আসে। কী করতে চায় ও, ফুল কিছুটা বোঝে। কিন্তু না বোঝার ভান করে। সবকিছু বুঝলেই হয় না। ওরও বুঝি ওইদিকেই টান। এই নিষিদ্ধ টানটা মানুষমাত্রেই আছে বলে নিজের টানকে সে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু বিয়ের আগে দিয়ে আলতাফ তাকে এমন কি কথা শোনাবে? সে-কথাই সে বোঝে না। কেন ওকে এত উপহার দেয়, কেন তাকে এত টাকা দেয়? এ-বিষয়টাই ফুল মাঝেমধ্যে গুলিয়ে ফেলে।
আলতাফকে ফুলের ভালোই লাগে। তবে বিশ্বাস হয় না। ছেলেটা যা বাটপার। গ্রামে তো এমনিতে মার্কামারা। তারপরেও মেয়েরা ওকে পছন্দ করে। মেয়েরা কেন এমন উড়নচণ্ডী ছেলেকে পছন্দ করে, তা বোধগম্য নয় ফুলের।
তিন
সন্ধ্যা লেগেছে। বাড়ির উঠোনে চুলা জ¦লে। কুড়িয়ে আনা সব ঝরাপাতা দিয়ে রান্না চলে। ধোঁয়ায় চোখ জ¦লে। মা মনে হয় পাশের বাড়িতে। ঠিক তখন কলাগাছের আড়াল থেকে আলতাফের ডাক ভেসে আসে। পাতা দিয়ে চুলা জ¦ালানো খুবই কষ্টের। চুলার কাছ থেকে এক লহমার জন্যও ওঠা যায় না। ‘ফুল’, আলতাফের ডাকে চোখ তুলে তাকায়। কিন্তু চুলা ছেড়ে উঠতে পারে না। একটু দূরেই কয়েকটা কলাগাছ। সেই অন্ধকারেই ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে থাকে আলতাফ। ফুঁসলায় বারবার। ‘আয় না ফুল। কানে দিমু দুল। করিস না আর ভুল। আয় না ফুল।’
কানের কাছে এমন ঘ্যানোর ঘ্যানোর ফুলের আর ভালো লাগে না। পরানটা ছোটে। আবার মার গরম খুন্তির ছ্যাঁকার কথাও মনে হয়। চুলার ভাত উনিশ-বিশ হলেই মা ঝাঁটা দিয়ে মারবে। মা না, যেন শত্রু। এমন মা যেন শত্রুরও না হয়। মনে মনে গজর গজর করে ফুল। এখন আলতাফকে কী করে ঠেকায়। খুব যেতে ইচ্ছে করছে ওর কাছে। ওর ফর্সা গোঁফ ওঠা চেহারাটা চোখে ভাসলেই কেমন কেমন লাগে ফুলের। ফর্সা হাতের ফাঁক গলে যখন সিগারেট খায়, তখন তো আর কথাই নাই। মাঝেমধ্যে ঘরের কাছের রাস্তা দিয়ে যখন সাইকেল কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মেরে যায়, তখন ‘সোনা বন্ধুরে’ বলে যে গানের টানটা দেয়, তখন কলিজার বোঁটা আলগা হয়ে যায়। যা থাকে কপালে, ‘ডরাইলে ডর। আলতাফ কি বাঘ না ভালুক? অয় কি আমারে খাইয়া ফেলাইব?’ এমন কিছু প্রশ্ন করে নিজেকে। সব প্রশ্নের উত্তর যখন না আসে, তখন ফুল উঠে দাঁড়ায়। ভাত হয়েই গেছে।
ইশারায় আলতাফকে একটু অপেক্ষা করতে বলে। ভাতের মাড়টা গেলেই যাবে সে। না হয় ভাত আবার জাউ হয়ে যেতে পারে। ভাতের মাড় গালা শেষ হলে চারদিকে তাকিয়ে ফুল কলাগাছের আবডালে যায়। অন্ধকারে আলতাফের বাহুবেষ্টন আজ আর ছোটাতে চায় না ফুল। এত কিছু নিয়ে এসেছে যে আজ মনটা আলতাফের জন্য ছটফট করে ওঠে। এদিকে আলতাফ দীর্ঘদিন পর ফুলকে কাছে পেয়ে ওর দেহের ঘ্রাণ নিতে থাকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই এক আশ্চর্য ভালো লাগায় হারিয়ে ফেলে নিজেকে ফুল। কলাপাতার ওপরেই যখন বাসরশয্যা পাতা হয়, ফুল তখনো টের পায়নি কী ঘটতে চলেছে। কিন্তু যখন ঘটে গেছে তখন ফুল আচমকা বিদ্যুতের শক খাওয়া মানুষের মতো ছিটকে পড়ে। ‘এইটা কি হইলো?’
আলতাফ হাঁসফাঁস করে। লোমশ বুকে দ্রুত শ^াস-প্রশ^াসের ওঠানামা। ফুল বারবার জিজ্ঞেস করে, ‘এইটা তুমি কি করলা?’ আলতাফ কোনো কথার জবাব দেয় না। সব ঝড় শান্ত হয়ে গেছে। এখন শুধু বিবেকের দংশন। আলতাফ ফুলকে বোঝায়, ‘কিছুই হইব না।’ সে ওকে বিয়ে করবে। ওর বিয়ে হওয়ার আগেই আলতাফ সব ব্যবস্থা করবে। কিছুতেই ফুলের এই বিয়ে হতে দেবে না। আলতাফের কথায় শান্ত হয়ে ফুল ফিরে আসে ঘরে। এক মুহূর্তেই যেন ওর বয়স বেড়ে গেছে। মাথায় শত চিন্তার ঝড় ফুলকে কেমন আনমনা করে দিয়েছে।
রাতে ওর শুধু আলতাফের কথা মনে হয়। একটা ঘোরের ভেতর ভালো লাগার ক্ষণটুকু ভাবতে ভাবতে না পাওয়ার মতো, না বোঝার মতো সময়টুকু ফেরত পাওয়ার জন্য ভেতরে আকুলিবিকুলি করে মনটা।
পরের দিন আলতাফ আসে। মুখে কথার ফুলঝুড়ি। এসেই আবার শরীর ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করতে চায়। কিন্তু ফুল ক্ষুব্ধ বাঘিনীর মতো হুংকার দিয়ে ওঠে। সব দেখে-শুনে আলতাফ সভ্য হয়েই কথা বলে। যেন নিজের ওপর তার অনেক কন্ট্রোল। কথা দিয়ে আস্তে আস্তে ফুলকে ভোলাতে চেষ্টা করে।
ফুলের চোখে নতুন স্বপ্ন। এ-কথা ফুল আর কাউকেই বলতে পারে না। আলতাফ যখন তাকে নিয়ে যাবে তখনই সবাই জানুক ব্যাপারটা – এটাই চায় ফুল। কিন্তু কয়েকদিন হয়ে গেলেও আলতাফের এই ব্যাপারটা আর ঘটে না। ফুলকে সে আর নিতে আসে না। ‘আলতাফ গেল কই?’
চার
ফুলবানুর বিয়ে হয়েই গেল। মুখডোবার ওই কুটু মোল্লার ছেলে তোফার সঙ্গে। বিয়ের পরপরই বুঝলো ফুল, এটাও তার জীবনে বড় আরেকটা ধাক্কা। শাশুড়িকে নিয়ে দুশ্চিন্তা হয়েছিল; কিন্তু দেখল সেই মহিলা ল্যাবাছেবা। বুঝেও অনেক কিছু না বোঝার ভান করে। কোনো হাঙ্গামাতে যেতে চায় না। সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করার পক্ষে। চোখের সামনে দিয়েও নিজের অনিষ্ট হয়ে গেলে কোনো রাও করে না। এমন মানুষকে ফুল সহ্য করতে পারে না। তাই শাশুড়িকে মিনমিন্যা শয়তান বলে আখ্যা দিয়ে রাখে নতুন বউ।
প্রথম রাতেই ধাক্কাটা আসে ফুলের ঘরে। জামাইকে বুকের ওপর থেকে নামাতে না নামাতে আরেকজন এসে ওঠে বুকের ওপর। ব্যাপারটা ফুলকে ঘাবড়ে দেয়। যুদ্ধ করে অনেক কষ্টে মুক্ত হয় ফুল। ব্যাপারটা নিয়ে স্বামীর সঙ্গে আলাপ করে। কিন্তু স্বামী তো অগ্নিমূর্তি। সব দোষ ফুলের। ফুলের সঙ্গে জিনের আসর। এসব আজগুবি কথাই স্বামী বলে। ফুলের সন্দেহ হয়। মনে হয় তার স্বামীও এর সঙ্গে জড়িত। বাকি রাত ঘুম হয় না। শাশুড়ির সঙ্গে আলাপ করে। শাশুড়ি কেমন আমতা আমতা করে। ফুল বোঝে, এ-পরিবারে কোনো ঘাপলা আছে। ফুল ভেবেছিল, স্বামী ছাড়া আরেকজনের বিরুদ্ধে লড়ছে সে। কিন্তু পরপর কয়েক রাতের পাহারায় বুঝলো এখানে আরো একজন রয়েছে। কিন্তু ফুল তিনজনের বিরুদ্ধে কীভাবে লড়বে? উপায় তাকে বের করতেই হবে। কয় রাত আর ঠেকিয়ে রাখা যায়। ফুলকে বুড়ো শকুনের হাতেও পড়তে হলো। বাকি রইল স্বামীর ছোটভাই।
মাথায় খুন চেপে গেল ফুলের। স্বামীর ভণ্ডামিটা বুঝতে পেরেছে সে। শাশুড়িও জানে, কিন্তু শ্বশুরের বিরুদ্ধে তিনি মুখ খুলতে নারাজ। তাহলে ফুল যদি মুখ খোলে ফুলের অবস্থা কী হবে? ফিরানিতে বাড়িতে এসে মায়ের গলা ধরে অনেক কান্নাকাটি করলো ফুল। ফুলের মা কিছুই বুঝতে পারল না। ফুল মাকে একান্তে ডেকে কিছু বোঝাতে চাইল। মা উল্টো ভুল বুঝল। কড়া হুঁশিয়ারি দিলো, যদি উল্টাপাল্টা কিছু করে সে, তাহলে মা গলায় ফাঁসি নেবে। ভয়ে ফুলের মুখ শুকিয়ে গেল। মা এসব কি বলে! মাকে সে কিছুতেই সবকিছু ভেঙে খুলে বোঝাতে পারে না। নিজের কষ্ট নিজের বুকের ভেতরেই জমা রাখল ফুল। এর বিহিত তাকেই করতে হবে। কাউকেই যখন এসব বলে বোঝানো যাবে না, তাহলে নিজের জীবন শেষ করে দেওয়া ছাড়া আর যা করা যায়, তা হলো ঘুরে দাঁড়ানো। ফুলের কান্নাকাটি দেখে এবার মা সঙ্গে ছোট বোনটাকেও দিলো। ছোট বোনটাও সাহসী হয়ে তার সঙ্গে এলো। কিন্তু ঘটনাটা কিছুতেই ফুল অন্য কাউকে বোঝাতে পারল না। রাতে ছোট বোনটাকে সঙ্গে নিয়েই শোয়ার ব্যবস্থা হলো।
কিন্তু রাতের বেলা ভয়ংকর সেই পশু স্বমূর্তিতে ফিরে এলো। ছোট বোনটি ঘুমের ভান ধরে জেগে সাহস করে বাতি জ¦ালাল। তার চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসার জোগাড়। ‘একি তালই মশাই আপনি এ অবস্থায় আমার বোনের রুমে কী করেন?’
ফুল বুঝতে পারে এবার হয়তো চরম আঘাত আসবে। ঠিকই তখন ফুলকে ওরা বেঁধে ফেলে রাখে। মুখের ভেতর কাপড় গুঁজে দেয়। ফুল অজ্ঞান হয়ে যায়। কতক্ষণ পর ওর জ্ঞান ফিরে বলতে পারবে না। ঠিক তখন ছোট বোনটা রক্তগঙ্গায় ভাসছে। কী করবে ফুল? বুঝতে পারছে না। কার কাছে সাহায্য চাইবে? আশেপাশের মানুষ কি সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে? অনেক কান্নাকাটির পর শাশুড়িকে রাজি করাল।
কোনো রকমে পরিকে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা হলো। কিন্তু বাঁচানো গেল না। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে পরিকে বাঁচানো সম্ভব হলো না।
এবারো দোষ পড়ল খারাপ জিনের ওপর। ভেতরে ভেতরে ফুলবানু দৃঢ় হলো। বোনের হত্যাকারী খারাপ জিনটাকে সে বাঁচতে দেবে না। তার বোন পরিবানুকে যেভাবে কষ্ট দিয়ে মেরেছে, ঠিক তেমন করেই বদজিনটাকে সে মারবে।
বদজিনটাকে বাগে আনতে ফুলের বেশি সময় লাগে না। বোনের মৃত্যুর মাসখানেকের মধ্যে ফুল অঘটন ঘটায়। বুড়ো শকুন আদার দেখলেই কপাৎ করে গিলে ফেলতে চায়। ক্ষেতের নিড়ানিটার ধার বেশি। বুকের ভেতরটা এক টানে ফেরে কইলজাটা নিয়ে আসে, তারপর সেটাকে আধখাওয়া করে ছিঁড়েভিঁড়ে রাখে। হোগলার বনে ফেলে দিয়ে আসে পাপিষ্টকে।
পরদিন হইচই পড়ে মুখডোবায়। ফুলের শ^শুরের লাশ পাওয়া যায় হোগলার বনে। পুলিশ এসে লাশ নিয়ে যায়। শাশুড়ির সঙ্গে লোক দেখাতে ফুলও কান্নার অভিনয় করে। তাতে লোকজনের সন্দেহ দূরে হয়ে যাবে। আগেও হোগলার বনে লাশ পাওয়া গেছে। গ্রামে খতরনাক ঘটনা কে ঘটায়, সে-রহস্য সবার অজানা।
তবে শাশুড়ি মনে হয় কিছুটা আঁচ করে। মনে মনে ফুলকে সন্দেহ করে। তবে তিনি মুখ খোলেন না। ফুলকেও কিছু বুঝতে দেন না। আশপাশে থেকেও ফুল জানতে পারে, এর আগের বউটিকেও এরা সবাই মিলে মেরে ফেলেছে। কিন্তু সে তো মরতে চায় না। সে বাঁচতে চায়।
পাঁচ
মিষ্টি রোদ। চুল খুলে রোদ পোহাচ্ছে ফুলবানু। অদূরে শিমের জাংলায় চোখ। হালকা শিশির এখনো লেগে আছে শিমের সবুজপাতায়। কিন্তু সাদা আর নীল ফুলটার ওপর একটা ভোমরা উড়ছে। তার দিকে চোখ থির করে রেখেছে ফুলবানু। দুই হাঁটুর মাঝখানে মুখটা গুঁজে দিয়ে মাটিতে কি আঁকিবুকি কাটছিল। হঠাৎ চোখ যায়। মনটা কেমন চনমন করে ওঠে। দৃশ্যটা চোখের মধ্যে আঠার মতো লেগে থাকে। কিন্তু থেকে থেকে টুনুরটুনুর আওয়াজটা মন ছুটিয়ে দিচ্ছে। কালো গাইয়ের বাছুরটা খড়ের গাদার কাছে লাফাচ্ছে। সাদা আর খয়েরি রঙের কি বাহার! চোখদুটো কাজল কালো। দু-একটা মুরগি খড়ের গাদার কাছে মুখ তুলে চেয়ে আছে বাছুরটার দিকে। ভাবছে কি করে বেটা! এমন টুনুরটুনুর করে লাফাচ্ছে কেন? সেদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ফুলবানু কত কী ভাবে। ভাবতে ভাবতে সে হারিয়ে যায়।
হোগলার বনের ওদিক থেকে পাখিদের ক্যাচরম্যাচর ভেসে আসে। সকালের আলো ফোটার পর আস্তে আস্তে কমতে থাকে পাখির শব্দ। একদিন সে ওই হোগলার বনে হারিয়ে যাবে বলে মাকে যে ভয় লাগিয়ে ছিল, সে-কথা মনে করে সে হেসে ওঠে। হোগলার বনের পরেই নদী। নদী আর হোগলার বন পরস্পর কেমন মিলেমিশে একাকার। জলকে তার ভয়। হোগলার বনকেও। এ পর্যন্ত কত যে নিমন্ত্রণ পেয়েছে হোগলার বনে যাওয়ার, তার হিসাব নেই। তবে যারা সঙ্গে নিতে চেয়েছে তারা সবাই পুরুষ। হোগলার বনেই সবাই নিতে চায়। একবার গেলে আর ফেরা নাই। সে নাকি শেষ। ফুল এসব বোঝে। তাই ওদিকে তাকালেই তার ভেতরটা কেঁপে ওঠে। সে এত ভীতু ভেবে নিজের ওপর আস্থা রাখতে পারে না।
এমন সময় তো মেঘ নেই। কে এমন রোদের ছায়া আড়াল করে দাঁড়াল? ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকাতে ইচ্ছে করে না। ফুলবানু হাঁক দেয়, ‘এই কিডারে সরিস কইলাম।’
ছায়াটা সরে না। থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ফুলবানু আবার হাঁক দেবে কি না ভাবতে থাকে। সে বুঝে যায় এটা কোনো ছেলেপেলের কাজ নয়। এটা অন্য কেউ। তাই সে কী ভেবে আর কথা বলে না।
পেছনে যে দাঁড়িয়ে থাকে সে বুঝি এবার অধৈর্য হয়ে ওঠে। ‘কিরে ফুল কেমন আছিস? কথা কইস না ক্যা? তোর দেমাগ দেহি আগের মতোই আছে।’
তাতেও ফুল কথা কয় না। ছায়াটা এবার বুঝি সরে যায়। ফুল উঠে দাঁড়ায়। এদিক-ওদিক তাকায়। খবিসটাকে কোথাও দেখতে পায় না। এবার সে খড়ের গাদার কাছে বাছুরটাকে ধরতে যায়। ফুলকে দেখে বাছুরটা তিড়িং করে লাফ মেরে গলায় ঝোলানো ঝুনঝুনি বাজাতে থাকে। ঠিক তখনি খড়ের গাদার অন্যপাশ থেকে একটা হাত ফুলের বুকে খাবলা মারে।
চিৎকারটা দিতে গিয়েও গিলে ফেলতে হলো। কারণ খচ্চরটা তার মুখ চেপে ধরেছে। কী হলো, কী হলো? কিছু বোঝার আগে ঝড়ের গতিতে হারিয়ে গেল সে। শুধু তার বুকটা ধড়ফড় করে উঠল। বড় বড় শ্বাস বুক চিরে ওঠানামা করতে লাগল ফুলের। বাঁ বুকটা ব্যথায় টনটন করতে লাগল। মুখ দিয়ে একটা খারাপ গালি উগরে দিলো। তারপরেও যদি মেজাজটা ঠান্ডা হয়! কিন্তু জ্বলতে লাগল। মনে হলো, কেউ চোতরা পাতা ঘষে লবণ লাগিয়ে দিয়েছে।
‘হারামির পো হারামি। খাইসটার ঘরে খাইসটা। খবিসের ঘরে খবিস। তোর লীলাও শেষ করুম।’
‘কিরে বিড়বিড় কইরা গাইল পারিস কারে?’ কে যেন পাশ থেকে জানতে চায়। রাগে ফোঁসে ফুলবানু। পাশে ফিরেও তাকায় না, কে কথাটি বলেছে। যে বলেছিল সে অবাক হয়ে অচেনা ফুলবানুকে দেখে।
ছয়
মুখডোবা। সন্ধ্যায় শালিকের ঝাঁক এত বেশি ক্যাচরম্যাচর করে যে, কান পাতা দায় হয়। প্রতিদিন একই চিত্র। সকাল-সন্ধ্যা পাখিদের এত উল্লাস যে কোত্থেকে আসে, তা কেউ ভেবে পায় না। কারো ইচ্ছে করে লাঠি নিয়ে পাখিদের তাড়িয়ে দিয়ে আসে। কারণ এই চিৎকার-চেঁচামেচি কানে তালা লাগায়। হোগলার বনে বারো মাস পানি থাকে। বর্ষায় বেশি। আর অন্যসময় হাঁটু পরিমাণ। কয়েক বিঘা নিয়ে হোগলার বন। ভেতরে জুতমতো কেউ হারিয়ে গেলে পথ পাওয়া মুশকিল। এ-গ্রামের লোকজন আজ অবাক হলো। কেন আজ শালিক ডাকে না।
আজ কেউ কেউ বিচলিত হলো। আলতাফ বলল, ‘এমুন ঘটনা না তো কুনোদিন শুনি নাই! হোগলার বনে পাখির ক্যাচরম্যাচর নাই। এইটা কি অইল?’ খুঁজতে গিয়ে লোকজন ঠিকই ফুলবানুর জামাইর লাশ নিয়ে এলো। বুকের কাছে একটা খাবলা দিয়ে কলিজাটা কেউ বের করে নিয়েছে। মনে হচ্ছে হিংস্র জানোয়ার আক্রমণ করেছিল। শোক মাতম ছড়িয়ে পড়ল পুরো মুখডোবাজুড়ে। হোগলার বনে এই অভিশাপ! কেমনে কী? সবার মনে একই প্রশ্ন। সবার মনে ভয়। আবার জানি কার লাশ পাওয়া যায় হোগলার বনে। এত এত ঘন ঘন লাশ পাওয়ায় পুলিশ প্রশাসনও নড়েচড়ে বসলো। মাতুব্বর, চেয়ারম্যান সবাই উঠেপড়ে লাগল, দোষীকে হাতেনাতে ধরার জন্য। বহুদিন পর ফুলবানু ভয় পেল। তার হাতের কাজ প্রায় শেষ। আর একজন মাত্র বাকি। আলতাফ। যে ওরে নষ্ট করেছে। উচ্ছিষ্ট বানিয়ে আর গ্রহণ করেনি।
‘ফুলরে নষ্ট করবা, গ্রহণ করবা না? এটা তো হয় না আলতাফ। শাস্তি পাইতেই হইব। ফুলের আদালত কঠিন। বড় কড়া বিচার। তোমার জারিজুরি শেষ। আর কোনো মাইয়ারে কান্দাইতে পারবা না তুমি।’
সকালের পরেই মুখডোবায় আলতাফকে পাওয়া যায় না। সেই সঙ্গে ফুলবানুকেও। মাতুব্বরের ছেলে আলতাফকে বিভিন্ন জায়গায় কথা বলতে দেখা গেছে। আজ সকালেও কেউ কেউ ফুলের সঙ্গে কথা বলতে দেখেছে আলতাফকে। লোকজন সন্ধ্যার পর জড়ো হতে থাকে মাতুব্বরের বাড়িতে। এ-কথায় সে-কথায় কেউ কেউ বলে আলতাফের লগে ফুলবানু কেন নিখোঁজ হইলো? ফুলবানুর বাড়িতে খবরটা নিলে তো হয়! কেউ কেউ বলে, আজকে বিকেলে, সন্ধ্যায় আলতাফকে কেউ দেখেনি। ফুলবানুর খোঁজ নিয়েও ফুলবানুকে পাওয়া যায় না।
কে বা কারা যেন বলতে থাকে, ‘আজকে হোগলার বনে শালিক পাখিরা কেন চুপ ছিল? এইটা একটা ভেবে দেখার বিষয়।’ আরেকজন বলে, ‘এসব পাগলের ব্যাপার-স্যাপার। পাখিরা ক্যান ডাকপে, ক্যান খাবে না, এই ডিউটি মানুষ নিবে ক্যাম্বায়? পাখিরা ওগো মতো থাকপে, খাবে।’ ফলে যে শালিক পাখি নিয়ে কথা বলছিল, সে চুপ হয়ে গেল। এক কথায় দুই কথায় কেউ কেউ প্রস্তাব উত্থাপনকারীকে পাগল ঠাউরায়। কিন্তু কেউ কেউ আস্তে আস্তে প্রস্তাবকারীর সঙ্গে একমত হতে চায় এবং বাঁশের মশাল জ্বালিয়ে হোগলার বনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকে। এতে যে কয়েকজন বাদ সাধে না, তেমন নয়। কিন্তু উৎসাহের ঘাটতি পরে না কোনো কিছুতেই। হাজার হলেও গ্রামে একটা না একই সঙ্গে দুইটা মিসিং কেস ঘটেছে।
তারপর ওরা কয়েকজন। উৎসাহী গ্রামবাসী একজন দুজন করে বাড়তে থাকে। হাতে বোম্বা। আলোকিত করে চারদিক। কয়েকটা খুন গ্রামবাসীকে উত্তেজিত করে রেখেছে। তাই তারা বের হয়ে পড়ে। হোগলার বন তোলপাড় করার পর ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন আলতাফের লাশ পাওয়া গেল। লোকজনের মুখে ফুলের আর আলতাফের একটা অসামাজিক সম্পর্কের কথা ভেসে বেড়ায়। কিন্তু খুনির প্রতি তাদের বিন্দুমাত্র সন্দেহ হয় না। তারা হোগলার বনে তোলপাড় করে ফুলের লাশ খোঁজে। এর আগে হোগলার বনে আরেকজন মেয়েমানুষের লাশ মিলেছিল। সে হলো জরিনা। মুখডোবাবাসী মনে করলো, এবার দ্বিতীয় মেয়েমানুষের লাশ ফুলবানুরটাও তারা হোগলার বনে খুব শিগগির খুঁজে পাবে।
খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, চিকিৎসা বঞ্চিত রোগীরা। বহিরাগত স্বাস্থ্য সহকারী দিয়ে চলছে জরুরী বিভাগের চিকিৎসা সেবা। বিভিন্ন অনিয়মে জর্জরিত হাসপাতালে কোনভাবেই ফিরছে না শৃঙ্খলা। সড়ক দুর্ঘটনায় আহত, গর্ভবতী নারী শিশুসহ বিভিন্ন ধরনের মুমূর্ষু রোগী জরুরী সেবা নিতে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গেলেও মিলছে দায়সারা চিকিৎসা সেবা। এমনকি বহিরাগত লোক দিয়ে জরুরী বিভাগে চিকিৎসা দেওয়ার অভিযোগ দীর্ঘদিনের।
উপজেলার শশা গ্রাম থেকে জাহিদ হাসান নামে এক ব্যক্তি অভিযোগ করে জানান , আমার ছেলে জুনায়েদ (৬ মাস) জ্বরে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হলে ২৩ জুলাই রাত ১০ টার দিকে আমার স্ত্রী নগরকান্দা হাসপাতালে নিয়ে যায়। জরুরী বিভাগে তখন কোন চিকিৎসক ছিলো না। একটা ছেলে বসা ছিলো সে চিকিৎসক নয় তারপরও ওষুধ লিখে দেয়েছে।
জানা গেছে, চিকিৎসক সংকটের কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছে হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থা। সেই সুযোগে ঘোলাটে পরিবেশে দায়সারা চিকিৎসা দিচ্ছেন চিকিৎসকগণ। বহিরাগত দুই জন স্বাস্থ্য সহকারীই চালাচ্ছে হাসপাতালের জরুরী বিভাগ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি জানান, বহিরাগত দুই জন স্বাস্থ্য সহকারী জরুরী বিভাগে সব সময় ফ্রি সার্ভিস দিচ্ছে। তবে ফ্রি সার্ভিসের আড়ালে তারা জরুরী বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের প্রাইভেট হাসপাতালে রেফার্ড করে।
এবিষয়ে আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার অভিজিৎ সাহা জানান, সালাউদ্দিন নামে একটি ছেলে জরুরী বিভাগে ডিউটিতে থাকে , সে মূলত চিকিৎসকের সহযোগী হিসেবে কাজ করে। কোন রোগী আসলে তার চিকিৎসা দেওয়ার কথা নয়, ডিউটিরত চিকিৎসককে ডেকে দেওয়ার কথা।
নগরকান্দা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা জয়দেব কুমার সরকার জানান, তারা (বহিরাগত স্বাস্থ্য সহকারী) চিকিৎসকদের সহযোগিতা করার জন্য থাকে, তবে তাদের চিকিৎসা দেওয়ার কথা নয়। তিনি আরোও বলেন, চিকিৎসক সংকটের কারণে এমন সমস্যা হচ্ছে।
এদিকে নগরকান্দা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. দবির উদ্দিন জানান, ইতোমধ্যে এক ভুক্তভোগী আমার নিকট অভিযোগ করেছে। আমি হাসপাতাল প্রশাসনের সাথে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
ফরিদপুর সিভিল সার্জন ডা. মাহমুদুল হাসান জানান, এমন কোন ঘটনা ঘটে থাকলে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এমন মেঘলা আকাশ আমি বহুবার দেখেছি। ছায়া ঘেরা, রঙহীন, নিঃশব্দ—যেন নিজের মধ্যে ডুবে থাকা কোনো বিষণ্ণ মানুষ। জানি না কেন, যখনই এমন আকাশ দেখি, মনে হয় ওটা আমারই প্রতিচ্ছবি। আমি যেমন হাসি লুকিয়ে রাখি মনের অন্ধকারে, তেমনি সে আকাশও সূর্যকে ঢেকে রাখে বুকের গোপন কষ্টে। যেন আমরা দুজন—আমি আর মেঘলা আকাশ—একই রকমের নিরবতা নিয়ে বেঁচে আছি।
ছোটবেলাতেই মেঘলাকে আপন করে নিয়েছিলাম। কারণ আমি কখনোই রঙিন সকাল কিংবা রৌদ্রোজ্জ্বল দুপুরের মানুষ ছিলাম না। আমার ভেতরেও বরাবরই একটা ঘন সাদা-কালো ভাব, যেটা বৃষ্টি নামার আগে আকাশে দেখা যায়। আশেপাশের মানুষজন যখন ঝলমলে দিনকে ভালোবেসে গান গায়, তখন আমি একা বসে থাকি জানালার ধারে—মেঘের দিকে তাকিয়ে। মেঘের মধ্যে কী আছে, জানি না। শুধু জানি, ওখানে কোথাও আমার মন লুকিয়ে আছে।
প্রতিবারই মনে হয়, আজ হয়তো আকাশ কেঁদে ফেলবে। আমিও তো কেঁদে ফেলতে চাই—অকারণে, অজুহাতহীন, শব্দহীন এক কান্না। কিন্তু পারি না। কারণ আমাকে শক্ত থাকতে হয়। আমার কান্না কেউ বোঝে না, কেউ দেখতে চায় না। তাই হয়তো আকাশও নিজেকে ধরে রাখে। তার বুকভরা জলের ভার, আর আমার বুকভরা হাহাকার—দুটোই যেন জমে থাকে এক জায়গায়, ফেটে না পড়ে কোনোদিন।
মেঘলা আকাশ এক রকমের প্রতারণাও করে। সে বলে, “আমি আসছি, তোমার মন ভালো করতে।” কিন্তু শেষে করে কী? আলো ঢেকে দেয়, বাতাস ভারি করে তোলে, চারপাশে এক ধরণের বিষণ্নতা ছড়িয়ে দেয়। ঠিক যেমন আমার জীবনের মানুষগুলো করেছে। তারা বলেছে—”ভালোবাসবো”, “সাথে থাকবো”, “তোমাকে বোঝার চেষ্টা করবো”—কিন্তু শেষে কি তা করেছে? করেছে ঠিক উল্টোটা। যেমন আকাশ, তেমনি তারাও।
আমি ভেবেছি, এই আকাশের নিচেই আমি হেঁটে যাবো অনেক দূর। একদিন কেউ বুঝবে আমার পথচলার ক্লান্তি। কেউ হয়তো ধরে ফেলবে, এই গাঢ় মেঘের ভেতর কতটা অসহ্য বিষণ্নতা জমে আছে। কিন্তু কেউ বোঝেনি। সবাই ব্যস্ত নিজের গল্পে, নিজের রোদে, নিজের সুখে। আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম একা, একদম একা, এক আকাশ-ভর্তি অনিশ্চয়তার সামনে।
আমার জীবনের প্রতিটি বড় মুহূর্তেই যেন এই মেঘলা আকাশ ছিল। পরীক্ষার খারাপ ফল, প্রথম প্রেমে ধোঁকা খাওয়া, বাবার অসুস্থতা, বন্ধুর বিশ্বাসঘাতকতা—সব কিছুর পেছনে ছিল এক ছায়াঘেরা আকাশ। যেন সৃষ্টিকর্তা আমায় বলেনি, “সব ঠিক হবে”—বরং বলেনি, “তোমার কষ্টটাই হবে তোমার পরিচয়।”
তবু আশ্চর্যের কথা, আমি এই আকাশকে ঘৃণা করতে পারিনি। বরং ভালোবেসেছি। কারণ আমি জানি, যেমন করে সে আলো ঢেকে রাখে, তেমনি আমিও হাসির আড়ালে কান্না ঢেকে রাখি। সে যেমন গর্জন করে—তেমনি আমিও গর্জন করতে চাই, কিন্তু পারি না। আমি তো মানুষ, আর মানুষ চুপ থাকে—বুকের সব আগুন নিয়েই।
একবার এক ভোরে, খুব তীব্র মেঘলা দিনে আমি রাস্তায় হাঁটছিলাম। চারপাশে লোকজন ছাতা হাতে ছুটছে, বৃষ্টি আসবে বলে। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম, যেন বৃষ্টির অপেক্ষায় না—বরং সেই মুহূর্তের সঙ্গে একাত্ম হয়ে থাকতে চাইছিলাম। হঠাৎ মনে হলো, এই আকাশ আমাকে জানে, আমার কষ্ট চেনে। এমনকি সে আমায় বলতে চাইছে—”আমি আছি, তুই একা না।” অদ্ভুত এক শান্তি এসেছিল সেদিন। যেন কারো কোলে মাথা রাখা, কোনো উত্তরহীন প্রশ্নের ছোট্ট একটা সমাধান।
এই আকাশ মাঝে মাঝে আমায় শেখায়, ভেঙে যাওয়ারও এক ধরনের সৌন্দর্য আছে। তুমুল বৃষ্টির পর যেমন আকাশ পরিষ্কার হয়, তেমনি হৃদয়ের কষ্ট সাফ করতে কষ্টের প্রয়োজন হয়। আমি ভেঙেছি, গুঁড়িয়ে গেছি, বারবার। কিন্তু প্রতিবারই উঠে দাঁড়িয়েছি। হয়তো আকাশও তাই করে—বৃষ্টির পরে আবার সেজে ওঠে নতুন করে, রংধনু আঁকে, সূর্যকে ডাক দেয়।
তবে আমার মনে হয়, মেঘলা আকাশই আমার আসল রূপ। অন্যরা হয়তো একদিন রোদ চাইবে, আলো চাইবে, পরিষ্কার আকাশ চাইবে। কিন্তু আমি চাই একটানা এক মেঘলা বিকেল—যেখানে কোনো শব্দ নেই, মানুষ নেই, কেবল আমি আর আমার নিরবতা। এই নিরবতাই তো আমার আত্মা, আমার শেকড়, আমার সত্য।
আমার জীবন কখনো সহজ ছিল না। ছোট ছোট ভালোবাসা পেয়েছি, বড় বড় ভুল করেছি, গভীর গভীর শূন্যতায় ডুবে গেছি। সেই শূন্যতা অনেকটা মেঘের মতো—দেখতে ভারি, কিন্তু ধরতে গেলে ফাঁকা। মানুষ যেমন আমার মনের ভেতরটা বুঝতে পারেনি, তেমনি তারা মেঘের ওজনও বোঝে না। কেবল দেখে, “আকাশ মেঘলা, বৃষ্টি আসবে”, কিন্তু বোঝে না, সেই মেঘে কতটা না বলা কথা জমে আছে।
আমার ভিতরে যে কষ্ট, তা আমি কাউকে দেখাই না। কারণ জানি, সবাই শুধু নিজের গল্প বোঝে। কেউ আমার আকাশের দিকে তাকায় না, কেউ আমার মেঘের ওজন মাপতে চায় না। তাই আমি চুপচাপ হাঁটি, মাথার উপর এক বিস্তীর্ণ মেঘলা আকাশ নিয়ে। সে আকাশই আমার সঙ্গী, আমার প্রতিচ্ছবি।
জীবনে কিছু কিছু মানুষ এসেছে, যারা বলেছে, “তুই খুব গভীর”। আমি হেসেছি। তারা জানে না, এই গভীরতা কোনো গৌরব নয়, একটা অভিশাপ। গভীরতা মানে একা হয়ে যাওয়া। গভীরতা মানে, কিছুই আর হালকা করে বলা যায় না, সব কিছুই বোঝানোর জন্য সময় লাগে, শব্দ লাগে, হৃদয় লাগে। তাই হয়তো আকাশও কিছু বলে না—সে শুধু থাকে, তার নিজের ছায়া নিয়ে।
আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় সময়গুলো ছিল তখনই, যখন বৃষ্টি নামছিল, কেউ ছিল না আশেপাশে, আর আমি একা দাঁড়িয়ে ছিলাম জানালার ধারে। সেই সময়গুলোতে মনে হতো, আমি নিজের কাছে ফিরে এসেছি। কেউ নেই আমাকে বদলাতে, কেউ নেই আমায় বোঝাতে—আমি কেবল আমি, একা, নিঃশব্দ, মেঘলা।
জানি না, এই আকাশ আর কতবার এমন করে ফিরে আসবে। জানি না, আমি আর কতবার নিজের ছায়া খুঁজে পাব মেঘের ভেতর। তবে এটুকু জানি—আকাশ যেমন তার রঙ বদলায়, আমিও একদিন বদলে যাব। হয়তো পুরোপুরি ভেঙে গিয়ে আবার নতুন করে গড়ে উঠব। হয়তো একদিন সূর্য উঠবে, কিন্তু আমি তবু তাকিয়ে থাকব মেঘের দিকে—কারণ সেখানে লুকানো আমার হৃদয়, আমার যন্ত্রণা, আমার আমি।
শেষে শুধু এটুকু বলি- যখনই কেউ বলবে, “আজ আকাশটা অনেক বিষণ্ন”—তখন আমি মনে মনে বলব, “না, আজ আকাশটা আমার মতো হয়েছে।”
আপনার মতামত লিখুন
Array