খুঁজুন
বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন, ২০২৫, ১২ আষাঢ়, ১৪৩২

প্রধান অতিথি হওয়া নিয়ে দ্বন্দ্বে ফরিদপুরে স্থগিত হলো বিএনপির কর্মী সম্মেলন 

ফরিদপুর প্রতিনিধি:
প্রকাশিত: বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন, ২০২৫, ৭:২২ এএম
প্রধান অতিথি হওয়া নিয়ে দ্বন্দ্বে ফরিদপুরে স্থগিত হলো বিএনপির কর্মী সম্মেলন 

ফরিদপুর জেলা বিএনপিকে সুসংগঠিত করতে সাংগঠনিক ভাবে ৮টি উপজেলা বিএনপির কর্মী সম্মেলন শেষ হলেও সদর উপজেলা বিএনপির কর্মী সমাবেশ সম্মেলন স্থগিত করা হয়েছে। তবে কি কারণে স্থগিত হয়েছে সে বিষয়টি কেউ সরাসরি মুখ খুলতে রাজি হননি।

বুধবার (২৫ জুন) দুপুরে ফরিদপুর শহরের অম্বিকা ময়দানে সদর উপজেলা বিএনপির কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। তবে এর আগে গত মঙ্গলবার দিবাগত রাতে কর্মী সম্মেলনকে ঘিরে অতিথি করা নিয়ে স্থগিত হয়ে যায় সম্মেলনটি। যা জেলা জুড়ে সদর উপজেলা বিএনপির কর্মী সম্মেলনটি নিয়ে চলছে নানা আলোচনা।

বিএনপির দলীয় একাধিক সূত্রে জানা যায়, কর্মী সম্মেলনে প্রধান অতিথি কে হবেন জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য সৈয়দ মোদাররেছ আলী ইছা না-কি ফরিদপুরের ৫ বারের সংসদ সদস্য চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফের মেয়ে কেন্দ্রীয় মহিলা দলের যুগ্ম সম্পাদক চৌধুরী নায়াব ইউসুফ। এমন প্রশ্নে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হওয়ায় স্থগিত করা হয়েছে এ কর্মী সমাবেশ।

উল্লেখ্য, আগামী ক্রিয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফরিদপুর-৩ আসনে দলীয় মনোনয়ন পেতে গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন সৈয়দ মোদাররেছ আলী ইছা এবং সাবেক মন্ত্রী কন্যা চৌধুরী নায়াব ইউসুফ।

জানা গেছে, ফরিদপুর সদর উপজেলা বিএনপির কর্মী সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সভাপতি জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আলী আশরাফ নান্নু, সদস্য হিসেবে রয়েছেন জেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক রশিদুল ইসলাম, মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক তানভীর হোসেন চৌধুরী, জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য শহীদ পারভেজ, জেলা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি আব্দুর লতিফ ও সদরের কৈজুরি ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি আব্দুল হান্নান।

এ ব্যাপারে গত মঙ্গলবার রাতে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির একটি সভা আয়োজন করা হয় আহ্বায়কের অফিসে। ওই সভায় সদরের সমাবেশ স্থগিত করে ফরিদপুর বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত দল পুনর্গঠন সংক্রান্ত সাংগঠনিক কমিটির টিমের উপর ন্যস্ত করে।

ফরিদপুর বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত দল পুনর্গঠন সংক্রান্ত সাংগঠনিক কমিটির টিম প্রধান হলে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেযারম্যান আসাদুজ্জামান তপন। সদস্যরা হলেন, বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক খন্দকার মাশুকুর রহমান ও সেলিমুজ্জামান ।

সদর উপজেলা কর্মী সম্মেলন স্থগিত হওয়ার ব্যাপারে জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও সদর উপজেলা বিএনপির প্রস্তুতি কমিটির সভাপতি আলী আশরাফ বলেন, কে এ সম্মেলনে প্রধান অতিথি হবেন বিষয়টি নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দেওয়ায় এ সমাবেশ স্থগিত করা হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, চৌধুরী নায়াব ইউসুফ ফরিদপুরের সাবেক মন্ত্রী মরহুম চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফের মেয়ে। ২০১৮ সালে তিনি ফরিদপুর-৩ (সদর) আসন থেকে বাবার পাশাপাশি ডামি প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। কামাল ইউসুফের মনোনয়ন পত্র বৈধ হওয়ার পর নায়াব তার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন। তিনি ফরিদপুর সদর বিএনপির কর্মী সম্মেলনের প্রধান অতিথি হতে চান। কিন্তু জেলা বিএনপির আহ্বায়ক সৈয়দ মোদাররেছ আলী নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। অথচ এর আগে চরভদ্রাসন ও ভাঙ্গার কর্মী সমাবেশে সৈয়দ মোদাররেছ আলীর জায়গায় প্রধান অতিথি হয়েছেন কেন্দ্রীয় কৃষক দলের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম। ওই দুটি সভায় জেলা বিএনপির আহ্বায়ক মোদাররেছ আলী ইছা উদ্বোধক ছিলেন। সেটা নাকি ছিল তার (মোদাররেছ) ব্যক্তিগত আর সদরের বিষয়টি রাজনৈতিক বিষয়!

বিএনপির একটি সূত্র জানায়, চৌধুরী নায়াব ইউসুফ ও সৈয়দ মোদাররেছ আলী যার যার অবস্থানে ছিলেন অনঢ়। কেউ কাউকে বিন্দুমাত্র ছাড়া দিতে রাজি না থাকায় এ সমাবেশের আয়োজন করা হলে মারপিট ও রক্তাক্ত সংঘাত সৃষ্টি হওয়ার শঙ্কা ছিল বিধায় সদরের কর্মী সমাবেশ স্থগিত হয়ে যায়।

ফরিদপুর জেলা বিএনপির সদস্য সচিব এ কে এম কিবরিয়া স্বপন জানান, সদরের কর্মী সমাবেশের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির কিছুটা ঘাটতি রয়েছে। যার কারণে সম্মেলন স্থগিতের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

এ ব্যাপারে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক সৈয়দ মোদাররেছ আলী বলেন, কিছু জঠিলতা সৃষ্টি হওয়ায় সদরের সমাবেশ স্থগিত করে কর্মী সম্মেলনের আয়োজনের জন্য ফরিদপুর বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত দল পুনর্গঠন সংক্রান্ত সাংগঠনিক কমিটির উপর ন্যস্ত করা হয়েছে।

স্থগিত হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মাশুকুর রহমান বলেন, এটা একটা মামুলি ব্যাপার। কোন জায়গায় কর্মী সমাবেশ আয়োজন ঘাটতি আছে, কিংবা সংঘাত হতে পারে বা কেউ অসুস্থ এ জাতীয় সমস্যা মনে হলে সমাবেশের সময় পিছিয়ে দেওয়া দোষনীয় নয়। এক্ষেত্রে হয়তো তাই হয়েছে।

তিনি বলেন, দলের সিনিয়র যদি কেউ অতিথি হতে চায়, সেই একই এলাকায় তার চেয়ে জুনিয়র যদি কেউ একই পর্যায়ে অতিথি হতে চায়, সেখানেও সমস্যা হতে পারে। বিএনপি একটা বড় দল, অনেক নেতাকর্মী নিয়ে চলাচল। তবে সংগঠন চলে দলীয় নীতিমালার আলোকে। তিনি আরও বলেন, কয়েক দিন বিলম্ব হলেও ফরিদপুর সদরের কর্মী সম্মেলন সফল ভাবে সম্পূর্ণ হবে আশা করি।

সালথায় ইয়াবাসহ দুই যুবক আটক

সালথা (ফরিদপুর) উপজেলা সংবাদদাতা
প্রকাশিত: বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন, ২০২৫, ১২:৫৪ পিএম
সালথায় ইয়াবাসহ দুই যুবক আটক
ফরিদপুরের সালথায় ১৪৭ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট সহ তামিম মোল্যা (২০) ও আল মাহমুদ (২২) নামে দুই যুবককে আটক করেছে পুলিশ।
বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) ভোর রাতে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে উপজেলার সোনাপুর ইউনিয়নের মোন্তার মোড় এলাকা থেকে সালথা থানার এসআই সমিত মজুমদার সহ একটি পুলিশ টিম অভিযান চালিয়ে তাদেরকে আটক করে।
আটককৃত তামিম উপজেলার মাঝারদিয়া ইউনিয়নের মাঝারদিয়া গ্রামের গোলপাড়া এলাকার কাউছার মোল্যার ছেলে ও আল মাহমুদ ভাওয়াল ইউনিয়নের নারানদিয়া গ্রামের আফজাল হোসেন মাতুব্বরের ছেলে।
সালথা থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) উজ্জল সরকার বলেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার ভোররাতে উপজেলার মোন্তার মোড় এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১৪৭ পিস ইয়াবা ট্যাবলেটসহ দুইজনকে আটক করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে নিয়মিত মামলা রুজু করে ফরিদপুর আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে।

জলে ভাসা নীলডুমুরের ফুল

সেলিনা শিউলী
প্রকাশিত: বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন, ২০২৫, ১২:৩১ পিএম
জলে ভাসা নীলডুমুরের ফুল

পিল পিল করে পায়ে হেঁটে মাটির কাঁচা রাস্তা ধরে ধূলি উড়িয়ে যাচ্ছে নানা বয়সী কিছু মানুষ। পথে পথে বাড়তে থাকে ঘরফিরতি উৎসুক মানুষের দল। এ-যাত্রায় মুখে আনন্দের বিন্দুমাত্র নেই, আছে বাতাসে ভর দেওয়া কানে-মুখে ফিসফিসানি। ছোটরা মুখ উঁচু করে কান খাড়া করে পাশের মানুষটা কী বলছে গোপনে তা জানার জন্য। হাঁটার পথে আছে উহ্-আহ্ শব্দ। কেউ কেউ কোনো কথা বলছে না, চেহারায় ভয় ও আতঙ্ক নিয়ে চলছে। কেউ ছুটছে ঊর্ধ্বশ্বাসে, কারো বা দৃষ্টিতে শূন্যতা। বাঁ পায়ে বাঘের কামড়ে মাংস তুলে নেওয়া ক্ষত নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দিগি¦দিকশূন্য হয়ে ছুটছে। আলিমের ছেলেবেলার বন্ধু করিমের হাতের লালরঙা গামছায় বাঁধা আলিমের কল্লাটা। আলিম কাঠ কাটতে গিয়ে বাঘের নিশানায় পড়ে যায়। তাকে টেনে বনের গভীরে নিয়ে যায় বাঘ। আলিম কিছু বুঝে ওঠার আগেই সব শেষ। সঙ্গীরা লাঠিসোটা নিয়ে খুঁজতে গিয়ে দেখে ওর ছেঁড়া শার্ট, প্যান্ট এদিক-সেদিক আর কিছু হাড়গোড় পড়ে আছে, অদূরে পড়ে আছে মাথাটা। এরপর গন্তব্য তাদের হাওলাদার বাড়ি।

পালের গোদা গ্রামের জসিম মাতবর। তিনি হাত-কাটা নাসিমুদ্দিন, ল্যাংড়া কাদেরসহ তিনজনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে এগিয়ে চলেছেন। নাসিমুদ্দিন বলে, কপাল আমাগো ভালো, এদিক আইছিলেন বইল্যা পাইলাম আপনেরে।

মাতবর বলে, হুম। কলিমরে চিনতাম আমি, এমন কইরা চইল্যা যাইবো তা ভাবি নাই। আল্লাহর হুকুম ছাড়া কিছুই হয় না রে।

তিনি নিজের মতোই বলতে থাকেন, শোনো মানুষ যেমন বাঘরে ভয় পায়, তেমনি বাঘ কিন্তু মানুষরে ভয় পায়। গুলপট্টি মারতেছি না, এ হইল সুন্দরবনের বাঘ। জিম করবেটসহ বিখ্যাত সব শিকারির কাছে শুনছি – সব জায়গাতেই মানুষখেকো বাঘ আছে, কম আর বেশি। কিন্তু সুন্দরবনের বাঘ কিন্তু মানুষের মতোই সেয়ানা আর চালাক। ছোটবেলা থেকে শুইনা আসতেছি, বাঘ নাকি ভরা পেটে থাকলে শিকারের পিছে ছোটে না; কিন্তু কখনো কখনো এই বনের বাঘ দুঃসময়ের জন্য শিকার করে সেই খাবার জমায়া রাখে। ওই শালা সেয়ানা, তক্কেতক্কে থাকে, যেই না একবার কাউরি একলা পালো, অমনি মনে কর তাকে শিকার করি ফালালো। আমি একবার এক লেখায় পড়ছিলাম সুন্দরবনের বাঘ নিয়া। সেখানে লেখছে, সুন্দরবনের লবণাক্ত পানি বাঘের যকৃৎ আর কিডনিকে আক্রান্ত করে, সেই কারণে বাঘের ভিতর অস্বস্তি তৈরি হয়। যে কারণে এখানকার বাঘ ভিতরে ভিতরে হিংস্র হইয়া যায়। বুঝলি কি হয়? বন বিভাগ তো কয়েছে রেজিস্টার্ড যারা তারা বনে যাতি পারবি না, কিন্তু মানা করলি তো আর প্যাট বাঁচবি না। প্যাটের খাওন চাই। বুঝলি, খাওন। ওসব আইনকানুন দিয়া কি আর প্যাট বাঁচে। এই প্যাটের জন্যি সব, এই প্যাটটা না থাকলি পরে ওসব নিয়মকানুন মানলিও চলে। এই যে আলিমডা মরল, সরকারি কিছু পাইব না। এই কারণে মনডা খারাপ হয়ি যায়।

নাসিমুদ্দিন বিস্ময় প্রকাশ করে বলে, কন কী? কি ভয়ংকর! শুধু নোনা পানির লাইগ্যা?

মুখে বললেও তার মনের ভেতর কিন্তু নানা কথা চলে, হাঁটে আর মাথা চুলকায়, সাহস পায় না, মাতবরকে কীভাবে বলে কথাটা। বলে, আলিম ভালা মানুষ আছিল। তয় হুজুর যাই কন, আলিমের বউডা ভাতারখাকি, অপয়া আর কুলটা। নাইলে এমুন হয়! দেখছেন এই বাপের জনমে মাথাডা ধড়ের লগেও নাই? বছর ঘুরতে না ঘুরতেই এক মাসের ছাওয়াল নিয়া বিধবা হয়? শঙ্খিনী জাতের মাইয়া এইডা। এই জাতের মাইয়া বিয়া করলি সাক্ষাৎ মৃত্যু – বলে বিজ্ঞের মতো ঘাড় নাড়ে নাসিমুদ্দিন।

শোরগোল শোনা যায়। উৎসুক বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় জটলা পাকানো মানুষের দল। আলিমের হাওলাদার বাড়িব দরজায় সমবেত হয় উৎসুক জনতা। এ-বাড়ির সামনে বহু মানুষের ভিড় আজ। উঠানে জায়গা হয় না, এত মানুষ। ফাল্গুন মাসের শেষ দিন, চারদিকে ঝকঝকা রোদ। বাতাসের তোড়ে আলগা ধুলোর ঝাপটা সবার চোখমুখ ছুঁয়ে যায়।

ঘরের পেছন দিকটায় গরু-ছাগলের বিচরণ বন্ধ করতে কাউফলা গাছের ডাল কলাগাছের ফেতনা দিয়ে বেঁধে, পুরনো মাছ ধরার জাল আর তালগাছের একটা ডাল কেটে করাত বানিয়ে গোবরজল, ধানের কুড়া আর আঠালো মাটি গুলে ঘরের পিড়া লেপতে ব্যস্ত তখন জমিরন বেওয়া।

বাড়ির বউ আছিয়া বেগম গত সপ্তাহে উঠান নিকিয়েছে। সে-উঠানে হোগলা পাটি বিছিয়ে শীতে নামানো লেপ-কাঁথা আর বালিশ শুকাতে দিয়ে, গাছ থেকে পড়া শুকনো পাতা ঝাড়ু দিয়ে একটি হাজিতে রাখছিল আছিয়া। দুই শরিকের ঘর, এক বাড়ি। পুরুষ বলতে কেউ নেই। আছিয়ার শ্বশুর মরেছেন বছর আটেক আগে। সুন্দরবনে জোংরা শামুক সংগ্রহ করতে গিয়ে তিনি বাঘের পেটে যান। সে বার দল থেক দূরে গিয়ে আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন নবীন হাওলাদার। হঠাৎ বাঘের আক্রমণে তার আর্তচিৎকারে উপস্থিত সবাই ভয়ে যে যেদিকে পেরেছে দৌড়ে পালিয়েছে। কিছুক্ষণ পর সবাই লাঠিসোটা নিয়ে এক জায়গায় জড়ো হয় বটে, ততক্ষণে সময় গড়িয়েছে অনেকটা। বনের ভেতরে কে আগে যাবে – এ জাতীয় দেনদরবার করতে করতে সবাই একসঙ্গে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তারা নবীন হাওলাদারকে ডেকে ডেকে সামনে এগোতে থাকে। বনজীবী যারা তারা অকুতোভয় হলেও তাদের বুকের ভেতরে ঢিপ ঢিপ শব্দ বাড়ে। দলটি আর খোঁজ পায়নি তার। জীবনের মায়ায় তারা গভীর জঙ্গলে না গিয়ে ফিরে এসেছিল। নবীনের বাড়িতে এসে খবরটা দিয়ে দায়মুক্ত হয় সকলে।

উঠানের সামনের ঘরে থাকে আছিয়ার চাচা শ্বশুর খালেক ও আছিয়ার দেওর হালিম হাওলাদার। তারা সাতদিন আগে বনে গেছে কাঠ কাটতে। এ-বাড়িতে মানুষ বলতে চাচি শাশুড়িসহ তারা মোট তিনজন নারী ও এক শিশু। বাড়িময় ছোটাছুটি করে পাশের বাড়ির ছেলেমেয়েরা খেলছে আর বারকয়েক উঠে পড়ছে সদ্য নিকানো পিঁড়ায়। অমনি গালাগাল দিয়ে সবার চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে শিশুদের শাপশাপান্ত করে জমিরন। এরপরও শিশুরা তাদের কানামাছি খেলা শেষ করে না। পরে ধমক খেয়ে পুরনো শাড়ি থেকে ছিঁড়ে ত্যানা বানিয়ে খড়ের ছোট্ট পুঁটলিতে শোয়া আছিয়ার ছেলেকে নিয়ে খেলতে বসে শিশুরা – শিশুটি তখন ও চোখ পিটপিট করে।

একসময় মানুষের জটলা এসে থামে মান্দার গাছ আর হোগলা পাতা দিয়ে ঘেরা দরজার সামনে।

ও কলিমের মা, কলিমের মা আছো বাড়িত?

এলাকার মাতবরের হাঁকে হাঁটুর কাপড় ঠিক করে ব্লাউজবিহীন ঝুলে পড়া স্তন সামলে মাথায় আঁচল টানে আধময়লা পুরনো শাড়িতে জমিরন।

বুকে ঢাক্ গুড়্ গুড়্ শুরু হয়নি তখন। কী কারণে ডাকছে তা দেখার জন্য এগোতে যাবে দরজায় ঠিক তখনই বাড়িতে ঢোকে দঙ্গলটি। গরিবের ঘরে হাতির পারা নয়, অশনিসংকেতের মতো ধেয়ে আসে পেছনে পেছনে মানুষগুলো। ঝাঁটা হাতে থমকে দাঁড়ায় আছিয়া। তার বুক হাঁপরের মতো ওঠে আর নামে। ভিড়ের মধ্যে কেউ একজন বলে ওঠে, মামা আইজ অসদয় হইছে, বনবিবির কথাও শোনে নাই। তোমার ছাওয়ালরে খাইয়া ফেলাইছে, নৌকার অন্য মাঝিরা অনেক দূর গিয়া হের পর কলিমের মাথাডা পাইছে।

মাতবর গলা খাঁকারি দিয়ে বলেন, আমরা তোমারে একটা খারাপ খবর দিতে আইছি। চোখ তার কথা বলতে বলতে ঘুরে আসে উঠানে দাঁড়িয়ে থাকা সবার দিকে। তারপর বলতে থাকেন ঘটনা। এমন ঘটনা এর আগে শোনেনি পাঁচ গাঁওয়ের  মানুষ। তার কথা শেষ হতে না হতেই মাথাটা কেমন জানি করে ওঠে আছিয়ার। সে নিকানো উঠানে লুটিয়ে পড়ে। ‘আল্লাহ গো মা গো’ বলে গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে ওঠে জমিরন বেওয়া। জোটভাঙা নারীর কয়েকজন এগিয়ে আসে। কেউ ছোটে পুকুরের দিকে। বদনায় পানি নিয়ে বউ আর শাশুড়ির মাথায় ঢালে।

জসিম মাতবর গলায় জমাটবদ্ধ কাশি সরাতে গলা খাকারি দেন, আশেপাশে তাকিয়ে বলেন – সবই ওপরওয়ালার ইচ্ছা, তোমার পোলা-ভাগ্য এমনই – কী করবা কও। হুনলাম বিয়ানবেলা আলিম গেছিল মাছ ধরতে, নৌকায় আর কেউ আছিল না। মামা ওরে একলা পাইয়া টাইন্যা নিয়া গেছে। আশেপাশের দুই-একজন মাঝিমাল্লা দেখলে পরে ডাকাডাকি কইরা লাঠিবৈঠা লইয়া ছুইটা গেছে। ওর মাথাডা বাঁচাইতে পারছে। বাকি সব হের প্যাডে। মানুষের হাতে সবসময় কিছু থাহে না, বান্দার হিসাব ওপরওয়ালাই ভালো জানেন। কথাগুলো বলে তাকান জমিরন বেওয়ার মুখের দিকে, ততক্ষণে মূর্ছা যাওয়া বউটা বসে থাকে এক হাত ঘোমটা দিয়ে। তাকে ঘিরে থাকা কয়েকজন প্রতিবেশী আড়েঠাড়ে আছিয়াকে বোঝাতে চায়, দোষটা যেন তারই। এখানে এসব জায়গায় স্বামী বাঘের খোরাক হলে বা কোনো বিপদ হলে দোষ এসে পড়ে বাড়ির বউয়ের ওপর। ধারণা করা হয়, বউয়ের চলন দোষে এমনটা ঘটেছে।

জরিমন বেওয়া জানে না সে কী করবে। বিলাপ করতে করতে মাতবরকে উদ্দেশ করে বলে, আমনেরা যা ভালো মনে হরেন, মোর কপাল পুড়ছে। ছোড পোলাডায় বাড়িত নাই, মোর কোন পাপে মোর পোলাডা গেলে?

মাতবর পকেট থেকে হাজার দুয়েক টাকা বের করে দেয় চাপা মুনসীকে – দাফন-কাফনের কাজ করার জন্য। মাতবরের খাস লোক এই মুনসী।

জমিরন বিলাপ থামিয়ে তাকায় টাকার দিকে। বলে, মোরা দুইজন মাতারি আর কি বুঝি? আমনেরা বুঝব্যবস্থা করেন। ওর বাপের মাতার লগে রাইখ্যা দিয়েন ওরে আপনেরা।

মাতবর শহরে যাওয়ার তোড়জোড় করে।

সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার শেষ গ্রাম নীলডুমুর। সুন্দরবনের বুড়িগোয়ালিনী রেঞ্জে গ্রামটির অবস্থান। এ-গ্রামের মানুষের জীবন জলের মতো স্বচ্ছ-সরল। নীলডুমুরের চারপাশে জলের নহর যেন। বুড়িগোয়ালিনী থেকে এ-গ্রামে যাতায়াত করা বেশ কষ্টকর – পাড়ি দিতে হয় ৭৫ থেকে ৮০ কিলোমিটার পথ। ইঞ্জিনের নৌকা বা স্পিডবোট যাতায়াতের উপায়। প্রতিটি ঘর লাগোয়া চিকন চিকন সড়ক সাবধানে পার হতে হয়। সে-পথেই তাদের নিত্যচলাচল। মাতবর ফিরে যেতে উদ্যত হন।

জানাজা পড়াতে আসা মসজিদের ইমাম বলেন, মোর জীবনে কহনও এমুন দাফনকাজ আর হয় নাই। মউত যে কার কেমনে হয় তা একমাত্র মাবুদই জানেন।

বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে কাকের শরীরের মতো। কমতে থাকে উৎসাহীদের উৎসাহ। দু-একজন প্রতিবেশী এসে দুজনকে সান্ত্বনা দিয়ে যার যার ঘরে ফিরে গেছে। পুরনো একটা কাপড় বিছিয়ে সেই থেকে নামাজ পড়ে আর কেঁদেই চলেছে জমিরন। মাঝে মাঝে বিলাপের সুরে বলতে থাকে – তার নসিব হলো না স্বামী আর ছেলের মরা মুখ শেষবারের মতো দেখার। ছেলের শরীরটা গেছে বাঘের পেটে, দেখার জন্য আছে শুধু ক্ষতবিক্ষত মুখ। তাও দুই চোখের কোনায় গভীর ক্ষত। এদিকে আছিয়া স্বামীর মুখটা দেখতে চাইলেও তাকে ওই বীভৎস চেহারা দেখাতে চায়নি উপস্থিত জনতা। তারা বলছিল, দোয়া করো, হের যে মউত হইছে, তার য্যান সব পাপ মাফ হয়।

এ গ্রামের সবাই দরিদ্র, বলতে গেছে হতদরিদ্র। খেটে খাওয়া মানুষ। নিজেদের দু-মুঠো খাবার জোগাড়েই সবার হিমশিম অবস্থা – অন্যকে সাহায্য করবে কীভাবে। এই রেওয়াজ এ-গ্রামে দেখাও যায় না। সবারই সবকিছু বাড়ন্ত।

আজ বাড়িতে চুলা জ্বালানো হয়নি সারাদিন। পেটের তাড়নায় চুলায় চাল আর আলু সেদ্ধ দেয় আছিয়া। জলডোবা ফোলা দুই চোখে অশ্রু। ভাবে – অমন সুন্দর শরীরডা, নাদুসনুদুস, কেমনে খায় বাঘে – তার বুদ্ধিতে কুলায় না। তার স্বামী যে নেই সেটাও যেন ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারে না আছিয়া। শুধু স্বামীর মাথাটার কথা মনে হতেই শিউরে ওঠে।

সহসা শাড়ির আঁচল সরিয়ে ব্লাউজের ফাঁকে একটু থুতু দেয় আছিয়া। ভাবে, যে-মানুষটা বছরের তিন মাস একসঙ্গে থাকল, তারে ভালো করে চেনা হয়নি, শরমের ভেদভাও বোঝা হয়নি, চোখ তুলে ভালো করে তাকানোও হয়নি, শুধু বিয়ের দিনক্ষণ হিসাবমতে ছেলেসন্তানের জন্ম দিয়েছে সে। সেই মানুষটা চলে গেল তার অভিমান নিয়ে, না পাওয়ার বেদনা নিয়ে, স্বপ্ন পূরণের কথা না বলে। মরে যাওয়ার আগে বাঘে যখন টেনে নিয়ে গেল তখন সে মাছ ধরায় ব্যস্ত ছিল ছোট ডিঙি নৌকাটায়। ক্ষুধার্ত বাঘটা যখন তাকে খেল, তখন কি দুর্বল শরীরে কোনো শক্তি ছিল না নিজেকে রক্ষা করার? এসব ভাবতে ভাবতে আছিয়ার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না বাতাসে মিলায়।

সারাদিন শুধু তার ছেলেটা কেঁদেছে। সন্ধ্যায় কোলের ছেলে বুকের দুধ পায়নি বলে আছিয়া রান্না করতে বসে। জমিরন শুয়ে আছে ছেঁড়া কাঁথাটা মুড়ি দিয়ে। সে ভাবে, এ-বাড়িতে তার ভাত উঠে যাবে। তার কান্নার দিন শুরু হলো। সে-কান্না দিনে গুমরে গুমরে নিশুতি রাতে হাহাকার মেশানো আর্তনাদে রূপ নেবে। আছিয়ার পরিবারেও বাঘে-খাওয়া মানুষ আছে।

স্বামী হারানোর পর থেকে আছিয়ার জীবন চলে ধুঁকে ধুঁকে। ঘরে চাল নেই। বাইরে গিয়ে কাজ করবে – সেটা চায় না জমিরন। তার মনে হয়, আছিয়া ঘরের বের হলে ঘরে আর ফিরবে না। তার বাপের বাড়ি থেকেও মেয়েকে নিতে এসেছিল। আছিয়ার শাশুড়ি নানা আচার আর নিয়মের বালাই দিয়ে বলেছিল – বছর পার না কইরা স্বামীর বাড়ির বাইর হওন যায় না …।

বাঘের নাম এ-অঞ্চলের মানুষের মুখে শোনা যায় না। সমীহ করে তাকে বলা হয় ‘মামা’। এখানকার মানুষ বুঝে নেয় তা। কেউ বাঘের নাম মুখে আনলেই ভয় পায়, যেন বাঘ খপ্ করে খেয়ে নেবে। দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করা মানুষগুলো বাঘের হাত থেকে বাঁচতে কত কিছুর আশ্রয় নেয়। বনে যাওয়ায় সময় দোয়াদরুদ পড়ে, সুস্থভাবে ঘরে ফিরে আসার জন্য মা ও ঘরের বউ সিন্নি আর বনমোরগ মানত করে। হিন্দু সম্প্রদায়ের নারীরা দেবদেবীর নামে জপ-তপ করে। তবে এখানকার সব ধর্মের মানুষই মনে করে, সুন্দরবনের রক্ষক বনবিবি। নারীরা তাদের স্বামীর সুস্থতা কামনায় যুগ যুগ ধরে বনবিবিকে সন্তুষ্ট রাখতে গান গায় –

রাতদুপুরে ঘরের চালে পেঁচায় দেলে ডাক

বেন বেলা কেন মাথার পরে কা কা করে কাক।

শোনো বলি মা বনবিবি

বলি গো তোমারে,

শোনো তুমি মা বনবিবি,

অভাগিনী শরণ নেলে

তোমারই চরণে ॥

ওমা তোমারই চরণে।

সুন্দরবনের চারপাশে গড়ে ওঠা গ্রামগুলোর মানুষ বনে যাওয়ার সময় নানা নিয়ম ও কৌশল মেনে চলে। তারা মনে করে, তাদের জীবন কঠিন নিয়মে বাঁধা। তাই তারা দিনক্ষণ দেখে বনবাদাড়ে যায়।

কলিমের দাফনের পরপরই বদলে যেতে থাকে আছিয়ার জীবন। জমিরন বেওয়ার পুরনো একটা সাদা থান এনে তাকে পরিয়ে দেয় প্রতিবেশী কয়েকজন নারী। তার তেল-না-দেওয়া উসকোখুসকো চুল ঢেকে দেওয়া হয় লম্বা ঘোমটা টেনে। ফ্যাকাসে সাদা শাড়ি পরা আছিয়ার মাথায় ঘোমটা আরো লম্বা হয়। খোয়া যাওয়ার ভয়ে নাকের একরত্তি ওজনের সোনার নাকফুলটা খুলে তার হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়। এখন তেকে খোলা চুলে আর কারো সামনে যেতে পারবে না সে। হাতের ক’গাছা কাচের চুড়িও ভেঙে ফেলা হয়। পায়ের স্যান্ডেল নেই, খালি পায়ে হাঁটাচলা। তার স্বামী যখন বনে যায় তখনো এমনই চালচলন ছিল তার। শুধু শাড়িটা ছিল বাংলা ছাপার। স্বামীর মঙ্গল কামনায় ও তার ফিরে আসার অপেক্ষায় এখানকার নারীরা এমনসব নিয়ম মেনে চলে। যতটা না নিজের ইচ্ছায় তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি সমাজের চাপে তারা এসব মেনে চলে। এ সময় কোনো পুরুষের মুখ ও ছায়াও তারা মাড়ায় না। আছিয়া নতুন নামে সমাজের কাছে পরিচিত হয়। সমাজ তার নাম দেয় ‘বাঘবিধবা’। বাঘের খাবার হওয়া স্বামীকে এসব নারী রক্ষা করতে না পারায় তারা বিশেষিত হয় অপয়া, কুলটা, ভাতারখাকি, রাক্ষুসী নামে।

চুলায় পাটকাঠি ঠেসে দিয়ে থুঁতনি হাঁটুতে রেখে চোখের জলের বাঁধ যেন মিশে যায়। গতকাল চালের ছাতু লবণ আর ঝোলা গুড় মিশিয়ে খেয়েছে দুপুরবেলা। রাতভর কিছুই খায়নি পানি ছাড়া। তাতেই জমিরন শুকরান গুজার করেছে। সপ্তাহ হলো আছিয়া স্বামীকে হারিয়েছে। ঠিকমতো খাওয়া নেই। বুকের দুধ অপুষ্ট ছেলেটা পায় না ঠিকমতো। সারাদিন ট্যাঁ ট্যাঁ করে কাঁদে। দেওরের খোঁজ নেই। লোকমুখ জেনেছে গহিন বনে থাকায় কিছুদিন দেরি হবে। তার মনে পড়ে, যাওয়ার দিন স্বামীর কাছে আবদার করেছিল এক ছটাক গরুর মাংস আনার জন্য, ফেরার পথে। রাতে নিজেদের একান্ত সময় কেটেছিল। আহ্লাদী হয়ে স্বামীকে বলেছিল সে-কথা। আলিম বলছিল ঠাট্টা করে, আমার ফুলবানুর লাইগ্যাই যামু বনে। আছিয়া আলিমের বুকে মাথা এলিয়ে দিয়ে লাজুক হাসি হেসেছিল চোখ বন্ধ করে। নিজেকে দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী মনে হয়েছিল তার।

সুন্দরবনের আশপাশের এলাকায় নোনাজলের কারণে খাওয়ার পানি জোগাড়ে যেতে হয় অনেকটা পথ। চিংড়ির ঘের পার হয়ে সামনে এগোতেই পথে দেখা হয় হরতন বিবির সঙ্গে। এই এলাকায় তিনি নানা কারণে নিন্দিত। নানা কথা চালু আছে তাকে নিয়ে। আছিয়া ভয় পায়। এড়িয়ে যেতে চায়। কিন্তু হরতন বলে, সেমাই যাও কেনে, মুই অপয়া নই। তুমিই কও, স্বামীরে মামা নিয়া গেল। আল্লাই কপালে রাখছিল। মোর ক্যান দোষে? মোর জীবনডা ফাঁসি দিছে সকলে। মোর কহন দিন গেইছে কহন রাইত তা ঠাহর করতি পারিনি। খালি যহন সলক হয়, তহন চায়ি দেখতাম রাইত পরিষ্কার হয়ি গেছে। অন্য কামকাজ করতি পারলে লাবলুর বাপ বনে যাতো না।

লবণ-পানির চিংড়ি ঘের না হলি মুইও বিধবা হতাম না।

হরতন কাঁদতে কাঁদতে জানায়, রাত দিন জাল টানা, জাল ধরা, তিনডা ছাওয়াল-পাওয়াল লয়া পার করতিছি দিন-রাইত। বেবাক সমান লাগে। পরের বাড়িত চায়াচিন্তে খাই। কেউ দিছে ফেন, চাউলের খুদকুড়া, চাউলে বা খুদে বেশি পানি দিয়া ভাতের মাড় দিয়া, নুন দিয়া খাওন নাগে। শাশুড়ি বলে, ওলো ভাতারখাকি, শঙ্খিনী, তোর সোয়ামিরে খাইছিস, মোগোও খাবি। যার সোয়ামি যায়, হে কতি পারে কী যায়, মোর চোখের পানি ছাড়া গতি নাই। মোক শিকল পরায়ে রাখে, সলক হওনের আগে খুলি দেয়। কয় – মোর পাপে ছাওয়াল হারায়ছে।

আছিয়া এক অদ্ভুত নির্জীবতা-নির্লিপ্ততা নিয়ে কলসি কাঁখে হরতনের কথা শোনে।

পানি নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আছিয়া ভাবে, তার জীবনে এখনো এমন কিছু ঘটেনি। দেওরের ঘরে ফেরার অপেক্ষা করে তার শাশুড়ি। তখন জানা যাবে সংসারের মতিগতি। সদ্যবিধবা আছিয়াও জানে, স্বামী বাউরে গেলে এসব নারী চুল আঁচড়াতে পারে না, চুলে তেলও মাখতে পারে না। তাদের খোলা চুলে চলাফেরা করা বারণ। এ-সময় তারা সাবানও ব্যবহার করতে পারে না। পরপুরুষের সঙ্গে কথা বলতে পারে না। এ-গ্রামের অলিখিত নিয়ম এটাই।

এতকিছু স্ত্রীদের মেনে চলার পরও যখন কারো স্বামী বাঘের আক্রমণে মারা যায়, তখন সব দোষ গিয়ে পড়ে স্ত্রীর ওপর। সমাজ ধরে নেয়, স্ত্রীর ব্রত পালনে কোথাও হয়তো গাফিলতি হয়েছে। তাই স্বামীর মৃত্যুর পর সমস্ত দায় তাকে বহন করতে হয়।

জমিরন বেওয়া আছিয়াকে ডেকে হাত ধরে বলে, এই গেরাম এমন আছিল না, মোরা ভালোই আছিলাম। ১৯৯০ সালের পর থেকে এসব অঞ্চলের চাষের জমিতে লবণ পানি তুইলে অনেক মানুষ চিংড়ি চাষ শুরু করে, আর মোগো কপালও পোড়ে। মোগের স্বামীরা কৃষিকাজ পায় না। মজুরির কাজও পায় না। মোগো কপাল পোড়ে। মোগো ব্যাডারা জাল দিয়া মাছ ধরতো, মধু আইন্যা বাজারে বেচতো, কাঠ কাটতি যাইতো বনে। সবকিছু এই পোড়া প্যাটের লাইগ্যা।

সে আছিয়াকে কাতর কণ্ঠে বলে, বউরে তুই মোরে ফালাইয়া যাইস না, তুই চইল্যা গেলে মাগো মোরে কে রাইন্ধা খাওয়াইবে। মুই না খাইয়া মইরা যাইমুগা। মোরে ছাইড়্যা যাইস না। হারপাই যেন মোর প্যাটে জম্মের খিদা।

শনিবারের দুপুরটা

ঝর্ণা দাশ পুরকায়স্থ
প্রকাশিত: বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন, ২০২৫, ১২:১৯ পিএম
শনিবারের দুপুরটা

শনিবারের দুপুরটা ভারী পাথরের মতো বুকে চেপে বসে থাকে। শুক্র, শনি ছুটি বলে এই দুটি দিন আনন্দে ভরে ওঠার কথা, অথচ তা হয় না। পায়েল ব্যস্ত হয়ে থাকে প্রণীলকে নিয়ে। প্রদীপ আর পায়েলের একমাত্র সন্তান নীল – প্রণীলকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে ওর মা।

পায়েল খুব কর্তব্যপরায়ণ। সংসারের কাজকর্ম করে মেশিনের মতো। ভোর থেকে ওর কাজ শুরু হয়। ঘড়ির সময় ধরে প্রতিটি কাজ করে যায়।

প্রদীপের খাবার ঢাকা রয়েছে টেবিলে। ওভেনে গরম করে এখনই খেয়ে নেওয়া যায়। তারপরও বিছানায় শুয়ে থাকে প্রদীপ।

বই পড়তে আগের মতো আর ভালো লাগে না। কেন যেন আজকাল আর মনঃসংযোগ থাকে না, টিভি চলছে, স্ক্রলিংয়ে মৃত্যুসংবাদ দেখে দেখে বুকের ভেতর কাঁপুনি জাগে। স্মার্টফোন হাতে নিয়ে ফেসবুক কিংবা ইউটিউবে ডুবে থাকতেও ভালো লাগে না। এই ভার্চুয়াল জগৎটাকে কেন যেন সে আপন করতে পারেনি।

ফেসবুকে নিজের একান্ত ভাবনাকে প্রচার করতে তার কেমন যেন দ্বিধা জাগে। নিজের দুঃখ-সুখ অগুনতি মানুষের কাছে ছড়িয়ে দিতে তার একেবারেই ইচ্ছে করে না। আমি গাড়ি কিনেছি, ফ্ল্যাট কিনেছি, গাজীপুরে ভাওয়াল রাজবাড়ি দেখে ছুটির দিনটা ভরিয়ে তুলেছি – কথাগুলো সবাইকে জানিয়ে কী লাভ?

তার এই ছুটির দিনের একাকিত্ব, বিষাদ-বিধুর সময় যে বুকের গভীরে বরফের চাঁইয়ের মতো বসে আছে – এ-কথা সবাইকে জানিয়ে কী হবে? কেউ তো তাকে সঙ্গ দিতে আসবে না। তার সুখ-দুঃখ নিজের হয়েই থাকুক।

হইহই করা কোনোদিন তার স্বভাবে নেই, মাথার ওপর মা-বাবা ছিলেন। সে-কারণেই হয়তো পারিবারিক জীবনে স্নিগ্ধ আবহ ছিল। বাবা প্রলয়কান্তি বাংলার অধ্যাপক ছিলেন। তার পড়াশোনার অভ্যাস ছিল ভীষণ রকমের। কত কিছু জানতেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দের কবিতার পঙ্ক্তি কণ্ঠস্থ ছিল তাঁর। শামসুর রাহমানের কবিতা ভীষণ পছন্দ করতেন। বাবা-মা থাকার কারণেই হয়তো তিন বেডরুমের ফ্ল্যাটবাড়িটা নন্দনকাননের মতো হয়ে থাকত।

কালের নিয়মে অবসর হলো প্রলয়কান্তির। সে-সময় বাড়িটি আরো ভরা ভরা লাগত। নানা ধরনের পত্রপত্রিকা, বই পড়ে সময় কাটাতেন তিনি।

মাঝে মাঝে ডাকতেন নাতিকে।

– মিস্টার নীল, নীলবাবু – কোথায় তুমি? এসো গল্প করি।

দাদু-নাতির এই গল্প করার সময়টুকু ছিল ভারি মিষ্টি-মধুর। গল্পের মাঝখানে নীল বারবার প্রশ্ন করত। দাদু খুব এনজয় করতেন ব্যাপারটি। ইনকুইজিটিভ না হলে ওরা তো কিছু জানতেই পারবে না।

কালের নিয়মে বয়স বাড়তে থাকল। সুস্থ-সবল মানুষটি ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যেতে থাকেন। শরীরে ভাঙচুর, দাঁতে ব্যথা, হাঁটুতে মাঝে মাঝে যন্ত্রণা। অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাতে গিয়ে মনে পড়ত, বয়স হয়ে গেছে, জীবনে করার আর তেমন কিছুই নেই। চারপাশে শুধুই হতাশা। গুটি গুটি পায়ে আসা

মৃত্যুচেতনায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকতেন তিনি।

তবুও তো মাথার ওপরে প্রলয়কান্তি ও দীপমালা ছিলেন। বিষাদ প্রদীপকে এমনভাবে গ্রাস করতে পারেনি। শরীর খারাপ হলে বাবা-মাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছে, ক্লিনিকেও ভর্তি করাতে হয়েছে। বাড়ির কাজেকর্মে কিছুটা ছন্দপতন ঘটেছে। নীলকে নিয়ে যাবে স্কুলে, ছোটাছুটির মাঝে ওর স্কুলও বাদ গেছে।

কিন্তু তারপরও স্বস্তি ফিরে এসেছে। সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরেছেন প্রলয়কান্তি।

মেসেঞ্জারে ফোন এলো পায়েলের।

– খেয়েছ?

– এখনো খাইনি।

– তার মানে? সোয়া তিনটে বাজে। কী, ঘুমিয়ে পড়েছিলে? এবার ওঠো। উঠেছ? কী যে করো না।

– উঠেছি, এক্ষুনি খাব।

– খাব বললে হবে না। ওভেনে

ভাত-তরকারি গরম করো, এরপর খেও। ঠান্ডা ভাত খেও না, ঠিক আছে?

গরম ভাত, তরকারি প্লেটে নিয়ে বসেই মনে পড়ে প্রতিটি মানুষ আসলেই একা, নিঃসঙ্গ। মা দীপমালা এত ভাবতেন ছেলেকে নিয়ে; কিন্তু চলে যাওয়ার পর কই একবারও তো আদুরে কণ্ঠ ভেসে এলো না মায়ের।

মা-বাবা দুজনেই অল্পদিনের ব্যবধানে চলে গেছেন।

মায়ের কণ্ঠ একবারও ভেসে এলো না, খেয়েছিস খোকন?

নাহ্, কেউ কোনোদিন জিজ্ঞেস করেনি। চলে গেলে কেউ আর ফিরে আসে না। বুকভরা স্নেহ-মমতা যতই থাকুক পার্থিব জগৎ থেকে চলে গেলে তাদের শুধু স্মৃতিটুকুই পড়ে থাকে প্রিয়জনের কাছে।

নীল মনমরা হয়ে থাকত অনেকটা সময়। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিল প্রদীপ। বাড়িতে বেশ কিছুদিন বিষাদের আবহ ছিল। পরিবারের দুজন বয়স্ক সদস্য চলে গেলেন অল্পদিনের ব্যবধানে। সংসারের যে-কোনো সমস্যায় তাঁদের অভিজ্ঞতা ও বিচক্ষণতা দিয়ে অনেক জটিল সমস্যার সমাধান করে দিয়েছেন। মা-বাবার এই ধরনের সহায়তায় নিজেকে বড় হালকা লাগত প্রদীপের।

এইমাত্র খাওয়া শেষ হলো। ফাঁকা বাড়িতে তার মনে হতে থাকে, পৃথিবী থেকে মানুষ চলে গেলে জাগতিক পৃথিবীতে কেউ আর তার দেখা পায় না – এই ভাবনা তার মনকে সব খোয়ানোর বেদনায় উদাস করে তোলে।

চোখ পড়ে দেয়ালে টানানো ছবির দিকে। মেঝেতে লুটানো ধুতির কুচি, গায়ে চাদর জড়ানো – বিদ্যাসাগরের বাঁধানো ছবিটি শিয়রের কাছে। এটা প্রলয়কান্তির শোবার ঘর ছিল। এখন এটা প্রণীলের পড়ার ঘর।

ছবি কথা বলতে পারে না। কোনো কালেই ছবি কথা বলে না, তবে উনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন বাবা প্রলয়কান্তি। বাবার মুখে গল্প শুনে একটু একটু করে বড় হয়েছে প্রদীপ। খুব স্থিতধী ছিল পুরনো সে-সময়।
বাবা-মা দুজনেই বলতেন, ধীরেসুস্থে চারপাশ দেখেশুনে পথ চলো। ছুটে যেও না।

তখন প্রকৃতি ছিল অনাবিল। নীল আকাশে দেখা যেত ঝকঝকে চাঁদ। ফাঁকা জায়গায় প্রচুর গাছগাছালি ছিল। ছোটদের খেলার মাঠ ছিল। এখনকার মতো স্কাইস্ক্র্যাপার ছিল না। শুক্লপক্ষে বাটির মতো চাঁদ দেখতে খুব ভালোবাসত প্রদীপ।

– এই দীপ, পড় পড়। জোরে জোরে পড় – এমন কথা কেউ বলত না। কারণ শহরে-গাঁয়ে-গঞ্জে চেঁচিয়ে পড়ত ছেলেমেয়েরা। তখনকার রেওয়াজ তাই ছিল।

এখন আর উচ্চকণ্ঠে কেউ পড়ে না। কম্পিউটারের মাউস নাড়তে নাড়তে, কমেন্ট লিখতে লিখতে ছেলেমেয়েরা মনে মনে পড়ে। হেসে ওঠে প্রদীপ, কী যে অদ্ভুত সব ব্যাপার!

গল্প শোনার মধুর দিনগুলো কোথায় যে ফেরারি হয়ে গেল। তবে ছেলেবেলায় বাবার কাছ থেকে গল্প শোনার স্মৃতি এখনো তাকে তাড়িত করে। কত মহামনস্বীর জীবনকথা। প্রলয়কান্তি সেই মহামানবদের গল্প শোনাতে গিয়ে তাঁদের মোস্ট গ্লোরিয়াস পারসনস্ বলে সম্বোধন করতেন। তিনি বলতেন, তাঁরা প্রাতঃস্মরণীয়, ভার্চুয়াস।

দেয়ালে দাঁড়িয়ে থাকা ঈশ^রচন্দ্রের গল্প তার অস্থিমজ্জায় মিশে আছে। পুরনো হয়ে গেছে বলে ছবির রং গাঢ় থেকে কিছুটা ফিকে হয়ে এসেছে, তবু ছেলেবেলা থেকে তাঁর কথা শুনতে শুনতে যেন প্রদীপের চলার পথে অদৃশ্য সাথি হয়ে থেকেছেন তিনি। মানুষটি ছিলেন তার সদাসঙ্গী।

আহা কী আনন্দময় ছিল তার ছেলেবেলা। বাবা শোনাতেন মহামানবের গল্প, রাতে দুধ-ভাত-কলা মাখিয়ে খাইয়ে দিতে দিতে দীপমালা বলতেন রূপকথার গল্প। তাই তো কল্পনার জগৎ এত প্রসারিত হয়েছে তার। নানা বৈষম্য নিয়ে সে ভাবতে পারে, ভালো-মন্দ নিয়ে সূক্ষ্ম বিচার করার ক্ষমতা তার রয়েছে।

মনে মনে ফুঁসতে থাকে প্রদীপ। ছুটির দিনেও বাচ্চাদের কোনো ছুটি নেই। নীল রং পেনসিল দিয়ে খেয়ালখুশিমতো আঁকিবুকি কাটতে পারবে না, গোল্লাছুট, লুকোচুরি খেলতে পারবে না। ফুটবল খেলা নেই, ক্রিকেটের ব্যাট দিয়ে বল পেটানো নেই – এ কেমন ছেলেবেলা!

মলিন মুখে পড়তে বসেছে নীল। ছুটির সন্ধ্যায় একটুখানি পড়ে নিয়ে ছুটে যেত সে দাদুর কাছে। এখানেই ছিল ওর নিশ্চিন্ত নিরুদ্বেগ আশ্রয়।

বিরক্তি মিশিয়ে পায়েল ডাকত, এই নীল, কোথায় গেলি রে? রিনরিনে গলায় জবাব আসত, গল্প শুনছি মা।

– ভেরি ব্যাড নীল, এখন কি গল্প শোনার সময়?

গমগমে গলায় প্রলয়কান্তি বলতেন, এত পড়া কিসের বউমা! আজকে ছুটি দাও ওকে। এমন করলে তো পড়াশোনার প্রতি অনীহা চলে আসবে।

শ্বশুরমশাইকে কিছু বলত না পায়েল। অনিচ্ছাসত্ত্বেও মেনে নিতে হতো এই নিয়ম। অস্থির নীল বলত, শুরু করো দাদু।

ইস্স কত যে আনন্দময় ছিল সেই দিন। পায়েল পড়ার টেবিলে এনে রাখে চিকেন স্যান্ডউইচ, পেয়ালায় হরলিকস।

মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে নীল বলে, আজ বাবির কাছে গল্প শুনি মম? ছুটির দিনের সন্ধ্যাবেলায় কি ছুটি দেবে না?

– শুয়ে শুয়ে এলেবেলে গল্প শুনলে কি হয় জানো?

– কী হয়?

– তোমার ভাগ্যও শুয়ে থাকবে।

– ভাগ্য শুয়ে থাকবে মানে?

বিরক্ত পায়েল বলে, তুমি বড্ড প্রশ্ন করো নীল। মানে হলো তোমার ক্লাসমেটরা এগিয়ে যাবে, তুমি এগোতে পারবে না, পিছিয়ে যাবে। তুমি হয়ে যাবে ব্যাকবেঞ্চার।

স্যান্ডউইচে কামড় দিয়ে দেয়ালের দিকে তাকায় সে।

– বাহ্ জায়গাটা ফাঁকা কেন?

হ্যাঁ, জায়গাটা বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। ছবির রং ফিকে হয়ে গেছে বলে নির্জন দুপুরে প্রদীপ খুলে রেখেছে ছবিটা। বিদ্যাসাগর নেই, কিন্তু এই মহামানবের গল্পটি শোনার যে খুব দরকার ছিল ওর। দাদু শুরু করেছিলেন কিন্তু মমের তাড়ার কারণে শেষ করে যেতে পারেননি। এখন আর গল্প কে শোনাবে ওকে?

গল্পটি শুনতে বড় ইচ্ছে করছে। সন্ধ্যাবেলা ও পড়ার টেবিলে আসবে বলে খাবারের কত আয়োজন করে মম। অথচ বীরসিংহ গাঁ থেকে এতখানি পথ হেঁটে শহরে আসতেন ঈশ্বরচন্দ্র। রাস্তায় গ্যাসপোস্টের নিচে এসে দাঁড়াতেন তিনি, এই আলোতে গুছিয়ে বসে তাঁকে যে পড়া তৈরি করতে হবে।

প্রদীপ ভাবে, এ নীলের মায়েদের মতো এত যত্ন নেওয়ার সময় ছিল না সেই সময়ের মায়েদের। তাঁরা ব্যস্ত

থাকতেন হেঁসেলের রাঁধাবাড়া নিয়ে, আত্মীয়-পরিজনের দেখভাল আর সংসারের ঊনকোটি কাজ নিয়ে।

এখন একটি সন্তানকে অলরাউন্ডার হতে হয়। সেদিকে মায়েদের থাকে কড়া নজর। শুধু সব সাবজেক্টে নাইনটি ফাইভ পারসেন্ট মার্কস পেলে হবে না, তাকে গান-আবৃত্তির ক্লাস করতে হয়। এ-যুগে জুডো-কারাতে শিখতে হবে আত্মরক্ষার জন্য। আর ফ্লুয়েন্ট ইংরেজি না শিখলে তো কোথাও এগোতে পারবে না।

এইটুকুন নীলকে নিয়ে পায়েলের এই প্রাণপণ ছোটাছুটিতে প্রদীপ কম বিরক্ত নয়। কখনো তবলার ক্লাস, কখনো আবৃত্তির ক্লাস, কখনো বা ইয়োগার ক্লাস, রেসের ঘোড়ার মতো দৌড়াচ্ছে পায়েল ছেলেকে নিয়ে।

বয়স হলে মা-বাবারা ওল্ড ফুলিশ ফাদার অ্যান্ড মাদার হয়ে যায়। ওরা ব্যাকডেটেড। এরপরও দীপমালা মাঝে-মধ্যে বলেছেন, ও কি কথা বউমা? এইটুকুন ছেলে, কত আর পড়বে? আমাদের কাছে বসুক না একটু। কখনো বলতেন, পিঠে যা একখানা ঢাউস ব্যাগ নিয়ে স্কুলে যায়, মেরুদণ্ড ভেঙে যায় কি না দ্যাখো।

পায়েলের তাৎক্ষণিক জবাব, যুগটা এমন হয়ে গেছে মা, শুধু পড়াশোনা করলেই হয় না, এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিসও থাকা চাই।

ছুটির দিনে নীলকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেও আগে কখনো এমন নিঃসঙ্গ মনে হয়নি। ভাত-তরকারি গরম করে ছেলেকে বেড়ে দিতেন দীপমালা। এখন মা-বাবা কেউ নেই। মাথার ওপর থেকে নিবিড় ঘন ছায়া সব সরে গেছে। চারপাশ এখন বড্ড ফাঁকা মনে হয়।

পায়েলের চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণার সঙ্গে মোটেও মিল হয় না প্রদীপের। ছেলেটা মাঝে মাঝেই কবি বলে ছোট্ট দুটি হাত দিয়ে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে। নিজের মনের কথা, এলেবেলে প্রশ্ন, স্কুলের সব ঘটনা প্রদীপকে শোনায় ওর মতো করে। বাবির মতো একনিষ্ঠ শ্রোতা সে কোথায় পাবে?

বাবার কথা মনে পড়ে যায়। প্রলয়কান্তি বলতেন, ওর শৈশবটা নিয়মের কারাগারে বন্দি হয়ে গেছে। হাসি-গান আর খেলার আনন্দ থেকে বঞ্চিত ছেলেটা।

বাবার কথাগুলো মনে হতেই বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে তার। এই প্রজন্মের ভবিষ্যৎ কেমন? ওরা কিসের স্বপ্ন দেখবে?

বাবা-ছেলের নিবিড় অন্তরঙ্গ মুহূর্তে পায়েল মাঝে মাঝে বলে ওঠে, আবার গল্প?

রুখুসুখু দুটি শব্দ শুনলেই প্রদীপের বুকের ভেতর ফেনিয়ে ওঠে ক্রোধের সাগর। যদি সে ফিরতি প্রশ্ন করে, তাহলে কি তোমার রুটিন ফলো করবে? এমন হলে তো গৃহযুদ্ধ বেধে যাবে। ছোট পরিবারের স্নিগ্ধ হাওয়া বিষময় হয়ে উঠবে।

সংসারের দেখাশোনা, বাবা-মায়ের সেবাযত্ন মন দিয়ে করেছে পায়েল; কিন্তু ছেলের ব্যাপারে কারো সঙ্গে সে আপস করতে রাজি নয়। ছেলে ওর একার – এমন করেই আগলে রাখে সে।

দীপমালা প্রায়ই বলতেন, নীলের যা করতে ভালো লাগে তাই করতে দাও না পায়েল।

– আপনার নাতি সবকিছুতেই না না বলে মা। লেখাপড়া ভালোভাবে না করলে ওর ভবিষ্যৎ কী হবে মা ভেবে দেখেছেন?

অতএব পড়া, পড়া এবং পড়া। সর্ববিদ্যায় বিশারদ হয়ে ওঠা, গলায় সুর নেই বলে গানের ক্লাস থেকে ছেলেটা রেহাই পেয়েছে নয়তো গানও শিখতে হতো ওকে। কপালে ফেটি বেঁধে ওকে রকস্টার হতে হতো।

করোনাকালের সময়টা ছিল ভারি অদ্ভুত। স্কুল নেই, টিচারদের বকুনি নেই, বন্ধুদের সঙ্গে খেলা নেই – খুব খারাপ সময় কেটেছে।

– ও মা, কী করব আমি?

এ শুধু নীলের নয়, ঘরে ঘরে ছোট বাচ্চাদের মন খারাপ।

মনে মনে অনেক খুশি হয়েছিল নীল। ছুটির দিনে

আবৃত্তি-তবলা-কুইজের ক্লাস নেই। আনন্দমাখা গলায় বলেছিল, এবার শুধু গল্প শুনব। উফ্ কি থ্রিলিং!

– খুব মজা তাই না। রাগি রাগি স্বরে পায়েল বলে। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে নীলকে ভর্তি করার সময় ঠান্ডা যুদ্ধ পরিবারে। কত কথাকাটাকাটি, যুক্তি দিয়ে বোঝানো। প্রলয়কান্তি তখন বেঁচে ছিলেন। তিনি বললেন, নিজের ভাষায় পড়াশোনা করুক দাদুভাই। নিধুবাবু কি এমনই এমনই বলেছেন –

নানান দেশের নানান ভাষা

বিনে স্বদেশী ভাষা মিটে কি আশা –

ভুরু কুঁচকে পায়েল বলেছে, কবিতাটি কতকাল আগের বলুন তো বাবা?

প্রদীপ বলেছে, কিছু কিছু কথা চিরকালীন সত্য। টুইংকল টুইংকল লিটল স্টার – এসব শিখতে তো বাবা মানা করেনি।

প্রলয়কান্তির এক গোঁ, নাহ্ নিজের ভাষাতে পড়বে নাতি। মাতৃভাষাতে পড়াশোনা করলে আত্মার বিকাশ ঘটে। পরিচিতজনরা সাধ্যের বাইরে গিয়েও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করিয়েছে। আত্মতৃপ্তিতে তাদের মন ভরে আছে।

মর্নিংওয়াক করতে গিয়ে দেখা হয় গুটিকয়েক কলিগের সঙ্গে। তাঁরা বলেন, তুমি বরাবর বড় একগুঁয়ে প্রলয়। বড্ড অ্যাডামেন্ট তুমি। যুগ পাল্টেছে, এ-কথা মনে রাখতে হবে তো। আমাদের নাতি-নাতনিরাও ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ছে।

প্রলয়কান্তি জবাব দিয়েছেন, যুগ পাল্টে দিচ্ছ তোমরা। জানো অনেক দেশে, এই যেমন জার্মানরা, ইংরেজি জানে; কিন্তু সহজে বলে না, নিজেদের ভাষাতেই ওরা কথা বলে। আমরা বিদেশি ভাষার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছি – কেন বলো তো? ঈশ^রচন্দ্রের কথাই ধরো, তিনি উনিশ শতকের একজন শিক্ষাবিদ ও সমাজ সংস্কারক ছিলেন।

– বাব্বা, তুমি পারোও বটে, প্রলয়। উনিশ শতকের মানুষকে নিয়ে পড়ে আছ এখনো?

ঘরে এসে বউমা পায়েলের কাছে হার মেনে নিতেই হলো প্রলয়কান্তিকে। প্রদীপও চেয়েছিল তার সন্তান মাতৃভাষায় পড়ালেখা করে এগিয়ে যাবে, কিন্তু তা আর হলো না।

প্রদীপের মনের বিষাদ ভেঙে এগিয়ে এলেন ঈশ্বরচন্দ্র। তিনি যেন বলছেন – এ আমি কোথায় এলাম প্রদীপ? বর্ণ পরিচয় – প্রথম ভাগ, দ্বিতীয় ভাগ কাদের জন্য লিখলাম আমি?

প্রদীপ বলে, ছেলেবেলায় আমি বইয়ে কি পড়েছি জানো? সদা সত্য কথা বলিবে, মিথ্যা কথা কখনো বলিও না। মাতৃবৎ পরদারেষু – পরের স্ত্রীকে মায়ের মতো মনে করবে, পরের দ্রব্যকেও লোষ্ট্রবৎ মনে করবে।

– বাব্বা, যা কঠিন শব্দ বাবি। আঁতকে উঠেছে নীল।

– লোষ্ট্র, মানে কি বাবি?

– লোষ্ট্র মানে ইট, পাথর, ঢিল। পরের জিনিসকে মনে করবে ঢিলের মতো। গাঁয়ের বাড়িতে গিয়ে পুকুরে তুমি ঢিল ছুড়তে, মনে নেই?

– এবার বলো বাবি রাস্তার পাশে বসে গ্যাসপোস্টের আলোয় ঈশ্চরচন্দ্র পড়তেন, উনার কি কোনো পড়ার টেবিল ছিল না? তাঁর রিডিং রুম ছিল না? অচেনা এই মানুষটির জন্য কষ্ট হতে থাকে নীলের।

সেই মুহূর্তে হঠাৎ করে বাতি নিভে যায়।

এ সময় থরথর করে কেঁপে ওঠে জেনারেটর। আলোকমালা জ¦লে ওঠে তক্ষুনি। বিদ্যুৎ নেই, কিছু সময়ের জন্য হলেও পড়াশোনা বন্ধ – তা হওয়ার জো নেই এখন। ঘরে ঘরে আইপিএস, প্রতিটি বিল্ডিংয়ে জেনারেটর রয়েছে। চব্বিশ ঘণ্টার জন্য আরাম-আয়েশ মজুত রেখেছে এই আধুনিক সময়।

কলিগদের কথার জবাবে প্রলয়কান্তি কণ্ঠস্বরে ঝাঁঝ মিশিয়ে বলেছিলেন, উনি না হয় পুরনো দিনের মানুষ, কিন্তু বাহান্নর ভাষা-আন্দোলন আর শহিদ মিনারের কথাও তো তোমরা ভুলে গেছ, এত বিস্মরণ কী করে হয় তোমাদের?

বাবা প্রলয়কান্তির কথাগুলো আজকাল কানে এসে

যখন-তখন ঝাপটা দেয়।

– বলো বাবি, তুমি থেমে গেলে কেন?

দাদুর কাছ থেকে গল্প শোনার অভ্যাস হয়েছে নীলের। শুনতে চায় ও মহামানবদের গল্প। দেয়ালে ঝুলে থাকা মানুষটির গল্প শুনতে বেশ লাগে তার।

মহামানবের গল্প। হ্যাঁ – শুনতে খুব পছন্দ করে নীল। কী করে ওঁরা বড় হলেন, কত কষ্ট সয়ে মাথা উঁচু করে উঠে দাঁড়ালেন, মানুষ কীভাবে জানল ওঁদের।

বীরভূম জেলার বীরসিংহ গাঁয়ে জন্ম তাঁর। পায়ে হেঁটে শহরে এসেছিলেন তিনি।

কিচেনের কাজ সেরে টিস্যু দিয়ে হাত মুছতে মুছতে পায়েল ফিরে এলো।

– গল্প শোনা হলো তো? এবার আবৃত্তি প্র্যাকটিস করো।

পায়েল মনে করিয়ে দেয়, সময় খুব ইম্পর্ট্যান্ট এখন। একে অপচয় করা কোনোমতেই চলে না। এ-যুগে টাইমকে টেম বানাতে হয়। এ-যুগে সময়কে পোষ না মানালে কি চলে? এ-যুগে ডিসিপ্লিনের মধ্য দিয়ে পথ চলতে হয়, নয়তো প্রতিযোগিতায় জেতা যাবে না। স্বপ্ন পূরণ তো হবেই না।

প্রলয়কান্তির যুগ, প্রদীপের যুগ চলে গেছে, এখন এসেছে নতুন যুগ। নতুন চিন্তাভাবনা, নতুন স্বপ্ন নিয়ে এসেছে অন্যরকম সময়। ভোরের জেগে ওঠা সূর্যের মতো তোমাকে পাংচুয়াল হতে হবে।

বাবা নেই, কিন্তু প্রলয়কান্তির কণ্ঠ শুনতে পায় প্রদীপ।

– বীরভূমের নদীটির নাম অজয়। তোমাকে গল্পটি বলিনি দীপ?

এটা ছিল ছেলের সঙ্গে বাবার বলা কথা। অনেক অনেক গল্পের সঙ্গে এ-গল্পটিও নীলকে শোনাতেন প্রলয়কান্তি। পছন্দের এই মহামানবের গল্প নিজের মনে নাড়াচাড়া করতে বেশ লাগে।

মায়ের অসুখ, মা দেখতে চেয়েছেন ঈশ্বরকে। যেতেই হবে মায়ের কাছে। মাতৃআজ্ঞা পালন করতেই হবে।

মনে মনে হেসে ওঠে প্রদীপ। এখন তো সে-যুগের মতো মা-বাবারা সন্তানের কাছে আইডল নন।

তবু অজয় নদী আর মানুষটির কথা ভোলা যায় না। প্রলয়কান্তি নানা গল্প বলে ছেলের অস্থিমজ্জায় মিশিয়ে দিয়েছেন নামগুলো। প্রদীপও চেয়েছিল ওর উত্তরসূরি প্রণীলের মাঝেও প্রবাহিত করে দিতে তার স্বপ্নকথা।

সে নিজেও গল্প শুনে শুনে বড় হয়েছে। ছেলেবেলায় অজানা গল্প শোনার আলাদা আকর্ষণ রয়েছে। বিশাল এই পৃথিবীতে কত গল্প যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে, সব গল্প শোনা বা জানা তো সম্ভব নয়। কিছু কিছু শিক্ষণীয় অজানা কথা জানা দরকার ছোটদের। প্রদীপের এ-কথা কিছুতেই মানে না দোয়েল।

বারবার সে ছেলেকে বলে, এই যে নীল, লুক অ্যাট মি, তাকাও আমার দিকে। কাল তোমার ক্লাস টেস্ট, ভুলে গেছ?

খেতে বসে পায়েল প্রদীপকে বলে, কী অতো ভাবো শুনি? শোনো ভেবে ভেবে কিছু হয় না। এই যে ছুটির দিনে নীলকে আবৃত্তির ক্লাসে নিয়ে গেলাম, এ-কাজটি তুমিও করতে পারতে। পারতে না বলো?

চিকেনের ঝোলে রুটি ডুবিয়ে মা আর ছেলের দিকে তাকায় প্রদীপ। মনে মনে বলে, আমি তোমার এই জয়যাত্রায় শামিল হতে চাই না পায়েল। তুমি কি কখনো ছেলেকে জিজ্ঞেস করেছ নীল কী চায়? কী করলে সে আনন্দে মেতে উঠবে?

গোপন নিশ্বাস ফেলে প্রদীপ। নীলের শৈশবটা একেবারেই অন্যরকম হয়ে গেল। নিজের ছেলেবেলার প্রতিটি দিন ছিল উৎসবের মতো। যন্ত্রের মতো চলা নীলের কাছে দিন-রাতের প্রতিটি মুহূর্ত রঙিন তো নয়ই, বরং ভীষণ ফিকে হয়ে আসে।

হ্যাঁ – জন্মদিন আজ প্রণীলের। তার স্কুলের বন্ধু কজন এসেছে। সারাঘর জুড়ে রং-বেরঙের বেলুন। চারপাশে নানা রঙের আলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে।

টেবিলের একপাশ উপচে পড়ছে রকমারি গিফটে। উড়োজাহাজের ডিজাইনে তৈরি কেক। চারপাশে কিশোর বন্ধুরা দাঁড়িয়ে আছে। ঝকঝকে ছুরিতে লাল ফিতে বাঁধা। নীল কেকে ছুরি ছোঁয়াতেই সুরে-বেসুরে গান গায় ছোটরা – হ্যাপি বার্থডে টু ইয়ার প্রণীল।

প্রদীপ এক পিস কেক খাইয়ে দেয় নীলকে। বন্ধুরা ছোটাছুটি করছে, একে অন্যের মুখে ক্রিম মাখিয়ে দিচ্ছে। হুল্লোড় করছে। এই নির্মল খুশিতে অনেকদিন পর মন ভালো হয়ে যায় তার।

খুব ব্যস্ত পায়েল। গুটিকয়েক বন্ধু মায়ের হাত ধরে এসেছে, ওরা ডিনার সেরে তবে বাড়িতে ফিরবে।

ঘরে এসে দাঁড়ায় প্রদীপ। ছবির চৌকো জায়গাটিতে চোখ পড়ে তার। বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। ড্রয়ার খুলে ফিকে রঙের বিদ্যাসাগরের ছবিটি ফের টানিয়ে রাখে। এবার সম্পূর্ণ হলো ঘরের অবয়ব। ধবধবে ধুতি পরা ঈশ্বরচন্দ্র সামনে এসে দাঁড়ান। তিনি উচ্চারণ করেন, কোথায় এলাম আমি?

এবার হাসে প্রদীপ।

– কেন, জন্মদিনের উৎসবে। আজ তো আমার ছেলে প্রণীলের জন্মদিন। আপনি আশীর্বাদ করবেন না?

যেন বিষাদমাখা স্বর তার।

– চামচ দিয়ে মা একটুখানি পায়েস ঠোঁটে ছোঁয়াল না? শুধু কেক খেল সবাই মিলে? তা কেকও সুস্বাদু খাবার। কেকের ক্রিম মেখে আনন্দ করছে ছেলেমেয়েরা, তাও দেখলাম। কিন্তু নিজের ঐতিহ্যকে ভুলে যাওয়া তো ঠিক নয়।

কই, ঘরে তো কেউ নেই। এই সন্ধ্যারাতেই কি প্রদীপ ঘোরের মাঝে রয়েছে? রং ফিকে হয়েছে বলে ছবিটি ড্রয়ারে রেখে দিয়েছিল, শুধু দেয়ালের একটি চৌকো জায়গা ফাঁকা হয়ে আছে বলে ফের টানিয়ে দিয়েছে প্রদীপ। ড্রয়িংরুমে ডাইনিংয়ে ছোটদের হইচই শোনা যাচ্ছে। বুক মন্থন করা নিশ্বাস ফেলে প্রদীপ। দীপমালা বেঁচে থাকতে প্রতিবছর নীলের জন্মদিনে চিনিগুঁড়া চালের পায়েস তৈরি করতেন।

– প্রথমে দু-এক চামচ পায়েস খাও, এরপর

কেক-চকলেট, চিকেন উইংস, বাটার নান খেও।

ছোটদের খাওয়া শেষ, এবার বড়দের পালা। আজ বেশ আনন্দ হলো। সবাইকে বিদায় দিচ্ছে নীল।

ব্যালকনি থেকে রাস্তা দেখা যাচ্ছে। রিকশা, অটো, ট্যাক্সি ছুটছে। গাড়িগুলো টেল লাইট জ্বালিয়ে ছুটছে দ্রুতলয়ে। শুধু ছোটা আর ছোটা। এ কেমন পৃথিবী, কারো দাঁড়ানোর এতটুকু সময় নেই। গাড়ি ছুটছে, মানুষ ছুটছে, রিকশা, বাস ছুটেই চলেছে। প্রদীপ ভাবে, এ যেন এক গোল্লাছুটের পৃথিবী। দুরন্ত সময়।

পায়েল বলে, বেশ কাটল আজকে – তাই না গো! নীলকে জিজ্ঞেস করে প্রদীপ, ঝুমঝুম, ভিভান, টিটো ওরা তোমার ক্লোজ ফ্রেন্ড – তাই না নীল।

– নো নো বাবি, নট অ্যাট অল। দে অল আর মাই চামস। দে আর বাডি।

ছেলের মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকায় প্রদীপ হ্যাঁ – ওরা সবাই অন্তরঙ্গ বন্ধু তো। এতক্ষণ খেলতে খেলতে ওরা বলছিল – কী রে ইয়ার, এদিকে আয়।

হ্যাঁ – বেস্ট ফ্রেন্ড, ক্লোজ ফ্রেন্ড তারা বলেছেন, ওগুলো চেনা শব্দ। কিন্তু বাডি আর চামস শব্দগুলো এই প্রথম শুনল প্রদীপ।

গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ড। আহা কী মোহিনী মায়ার জগৎ। এমন স্মার্ট কথার তরঙ্গে ভেসে গেছে বিদ্যাসাগরের বর্ণ পরিচয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ। নতুন প্রজন্মের নওল কিশোরদের ছুটন্ত মিছিল দেখে তিনিও বুঝি ভাবনায় পড়ে গেছেন। ছবিটি দেখে প্রদীপ। দেখে, তাঁর মলিন আর বিষণ্ন মুখ।

সত্যিই তো, মন খারাপ হবে না তাঁর? তিনি যে শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারকও। সমাজের জন্য তিনি ভাববেন না তবে কে ভাববে? রাতের বাতাসে ভেসে আসছে হটডগ আর পিৎজার ঘ্রাণ।

– দেয়ালটা ফাঁকা লাগছিল কেন বাবি? ওই তুমি তো দাদুর গডফাদার বিদ্যাসাগরের ছবিটা সরিয়ে দিয়েছিলে। সত্যি উনি খুব সাফার করেছেন বাবি। তাঁর স্টাডিরুম ছিল না। কর্নফ্লেক্স, হরলিকস খেতেন না। ওসব তো নাট্রিসিয়াস বাবি।

পায়েল এসে ঘরে ঢোকে। সব কাজ সারা হয়ে গেছে। শুধু বর্ণালি বেলুন উড়ছে, ঘরে সুগন্ধি ফুল থেকে মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। মন আজ ভীষণ ভালো ওর।

প্রদীপকে বলে, আজ তোমার গল্প শুনব। বলো এবার।

– তাই? বলো বাবি আজ আমরা দুজনেই গল্প শুনব – তাই না মম, হাসির আভা খেলে যায় প্রদীপের মুখে। আজ ভার্চুয়াসদের গল্প শোনাবে সে।

– তাহলে শোনো, ঈশ^রচন্দ্র শুধু যে লেখাপড়ার জন্য কাজ করেছেন, তা কিন্তু নয় পায়েল, মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দেখলে তার প্রাণ কেঁদে উঠত। এজন্য তিনি কম কষ্ট পাননি। চেনাজানা সবাই বলত, কেন তুমি ওসব করে বেড়াও? এ তো ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো ব্যাপার।

কথাটি শুনে হেসে ওঠে নীল।

– সত্যিই তো, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ায় কেউ? প্রদীপ বলতে থাকে, শম্ভুনাথ বাচস্পতি নামে একজন অতিবৃদ্ধ কুলীন ব্রাহ্মণ বিয়ে করেছিলেন কিশোরী এক মেয়েকে। ওদের বাড়িতে একদিন গিয়ে বুড়ো লোকটির পাশে কচি মেয়েকে দেখে ঈশ্বরচন্দ্রের প্রাণ কেঁদে ওঠে। অবোধ এক কিশোরী মেয়ে।

স্বামীর মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে পায়েল। সেই সমাজের কথা কিছুই তো জানে না সে। নীলের মা জানে শুধু এ-যুগের কথা। গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ডের চাকচিক্যে পায়েল বিভোর।

প্রদীপ আপনমনে বলতে থাকে, বিদ্যাসাগর ছিলেন সদ্বিবেচনার মানুষ। তিনি উপলব্ধি করলেন, অল্পদিনের মাঝেই বয়োবৃদ্ধ মানুষটি মারা যাবে। অবোধ বালিকাটি বিধবা হবে। মেয়েটি যে বুঝতেই পারবে না দাম্পত্য সুখ আর আনন্দের কথা।

পায়েলের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে বলে, কী দুর্ভাগিনী বলো তো মেয়েটি। হতবাক পায়েল বলে, সত্যিই কি তিনি মানুষের জন্য এত ভাবতেন?

ওর কথাগুলো হাহাকারের মতো শোনায়।

– তাই তো বলি পায়েল, তিনি মহামানব। বালিকার কচি-কোমল মুখের দিকে তাকিয়ে সেদিন মানুষটি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, এ-ভিটেতে কখনোই আমি জল স্পর্শ করব না। এ আমার নীরব প্রতিবাদ।

ঘরে করুণ নীরবতা ঘনিয়ে আসে। পায়েলের কাজলমাখা দু-চোখ ছলছল করে। প্রদীপের আবেগমাখা কথা শুনে এ-যুগের মেয়ের মনে বেদনায় ভরে যায়। পায়েল বলে, তুমি এত চমৎকার করে গল্প বলতে পারো? স্ত্রীর মুখে প্রশংসা শুনে উৎসাহিত হয়ে ওঠে সে।

– এমন মানুষকে নিয়েও ব্যঙ্গ করে কত কী বলেছে লোকজন।

এক যে ছিল বিদ্যাসাগর বুদ্ধিশুদ্ধি কই –

শিখেই চলে লিখেই চলে শিশুপাঠ্য বই।

বিছানায় গুটিশুটি হয়ে মা-বাবার কথা শুনছে নীল, ওর চোখে আজ ঘুম নেই।

বেশ রাত হয়েছে। গল্পে ডুবে থাকা দুটি মানুষ খাবার কথা ভুলে গেছে।

খাবার টেবিলে ভাত-তরকারি সাজিয়ে মা ডাকে, – শিগগির এসো নীল, খেতে এসো।

প্রদীপ খেতে বসেছে। চামচ-প্লেটের মৃদু আওয়াজ ভেসে আসছে। হ্যাঁ – এবার খেতে যাবে। তবে তার আগে স্টাডিরুমে যাবে ও। দেয়ালে সটান দাঁড়িয়ে থাকা ঈশ্বরচন্দ্রের ছবির দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে সে। ‘ভালোবাসি ভালোবাসি তোমাকে।’ মনে মনে নীল উচ্চারণ করে, হ্যালো বিদ্যাসাগর, তুমি সবার কথা ভেবেছ। কত বই লিখেছ তুমি। আমি তোমার বই পড়িনি জানো? এবার থেকে পড়ব। তোমার কাছে প্রমিস করলাম, তোমার বই আমাকে পড়তেই হবে। তুমি একদম মন খারাপ করবে না।

ভেজা ভেজা গলায় নীল বলতে থাকে, তোমার কথা বলতে বলতে বাবির মুখ গ্লুমি হয়ে গেছে। মমের চোখ ছলছল করছে। ‘টিয়ারফুল আইজ’ মায়ের। আমারও যে ভীষণ কান্না পাচ্ছে তোমার জন্য। বিলিভ মি।

ঈশ^রচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ফিকে ছবিটির দিকে তাকিয়ে নীলের অশ্রুবিন্দু ঝরতেই থাকে।