‘স্বামী বিদেশে, ঘরে শুধু অপেক্ষা’
CREATOR: gd-jpeg v1.0 (using IJG JPEG v62), quality = 82?
ভোরের আলো ফোটে, কিন্তু ঘুম ভাঙে না সালমার। ঘুম ভাঙানোর কেউ নেই। মোবাইল ফোনটা বালিশের পাশে রেখে দেন—যদি হঠাৎ মালয়েশিয়া থেকে স্বামীর কল আসে। পাঁচ বছর আগে কাজের সন্ধানে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন স্বামী। সেই থেকে সালমার জীবন কেবল অপেক্ষা আর দায়িত্বের ভারে বাঁধা।
বাংলাদেশে এমন সালমা একা নন। লাখো নারী আছেন, যাদের স্বামী দীর্ঘদিন প্রবাসে। বাইরে থেকে তাদের জীবন স্বচ্ছল মনে হলেও ভেতরে জমে থাকে নিঃসঙ্গতা, দুশ্চিন্তা আর না বলা কষ্ট।
দিনের বেলায় তারা শক্ত। সন্তানের স্কুল, সংসারের খরচ, শ্বশুর-শাশুড়ির দেখাশোনা—সবই সামলাতে হয় একাই। কিন্তু রাত নামলেই বুকের ভেতর জমে থাকা শূন্যতা আরও গভীর হয়। তখন স্মৃতি কথা বলে, চোখ ভিজে ওঠে।
ফরিদপুরের সালথা উপজেলার গৃহবধূ মমতাজ বেগম বলেন, “স্বামী মাসে টাকা পাঠায়, কিন্তু সন্তান যখন বাবার হাত ধরে হাঁটতে চায়—তখন আমার কোনো উত্তর থাকে না।”
প্রবাসী পরিবারের নারীরা সামাজিকভাবে অনেক সময় ‘ভাগ্যবতী’ হিসেবে চিহ্নিত হন। কিন্তু বাস্তবে তারা প্রতিদিন লড়াই করেন একাকিত্ব, নিরাপত্তাহীনতা আর সামাজিক চাপের সঙ্গে। অসুস্থ হলে একাই হাসপাতালে যেতে হয়। কোনো বড় সিদ্ধান্ত নিতেও একাই ভাবতে হয়। তবুও সমাজের সন্দেহের দৃষ্টি আর কটু কথা সহ্য করে তারা চুপ থাকেন।
অনেকে সময় কাটানোর চেষ্টা করেন কাজের মাধ্যমে। কেউ সেলাই করেন, কেউ হাঁস-মুরগি বা গবাদিপশু পালন করেন, কেউ ছোট অনলাইন ব্যবসা শুরু করেছেন। এসব ব্যস্ততা কিছুটা স্বস্তি দিলেও মনের শূন্যতা পুরোপুরি ভরাট হয় না।
মনোবিজ্ঞানীদের মতে, দীর্ঘদিন স্বামী-স্ত্রীর দূরত্ব নারীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। হতাশা, একাকিত্ব ও আত্মবিশ্বাসের অভাব বাড়ছে। কিন্তু গ্রামবাংলায় এসব অনুভূতি প্রকাশ করাকে এখনও দুর্বলতা হিসেবে দেখা হয়।
সমাজকর্মী শারমিন আক্তার বলেন, “প্রবাসী পরিবারের নারীদের জন্য মানসিক সহায়তা ও সামাজিক সুরক্ষা খুব জরুরি। পরিবার ও সমাজ যদি পাশে দাঁড়ায়, তাহলে তারা আরও শক্ত হতে পারেন।”
তবুও এই নারীরা ভেঙে পড়েন না। সন্তানের ভবিষ্যৎ আর পরিবারের সম্মানের জন্য তারা নিজেদের কষ্ট গোপন রাখেন। ঈদের দিন নতুন জামা পরে হাসেন, ভিডিও কলে স্বামীর সামনে সব ঠিক আছে বলে জানান—যেন দূরের মানুষটি দুশ্চিন্তায় না পড়ে।
সালমা বলেন,“আমি কাঁদি রাতের অন্ধকারে। দিনে সবাই ভাবে আমি খুব শক্ত।”
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে দেশের অর্থনীতি শক্ত হয়। কিন্তু সেই অর্থনীতির নীরব ভিত গড়ে তোলেন এই নারীরাই—যারা প্রতিদিন নিজের আবেগ বিসর্জন দিয়ে পরিবার আগলে রাখেন। তাদের এই নীরব ত্যাগের গল্প বলা দরকার। কারণ তারা শুধু অপেক্ষা করেন না—তারা প্রতিদিন লড়াই করেন, নীরবে, সম্মানের সঙ্গে।

আপনার মতামত লিখুন
Array