চার প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
সরকারের তিনজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি) ও একজন উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ (ইউএনও) ১৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত ১৭ ডিসেম্বর দুদকের নওগাঁ সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপসহকারী পরিচালক আল মামুন মামলাটি করেছেন। তবে এখনো তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়নি।
মামলার আসামিরা হলেন রাজশাহীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) ও কালাই উপজেলার সাবেক নির্বাহী কর্মকর্তা টুকটুক তালুকদার, নওগাঁর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (উন্নয়ন ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা) ও কালাই উপজেলার সাবেক নির্বাহী কর্মকর্তা জান্নাত আরা তিথি, নাটোরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ও কালাই উপজেলার সাবেক নির্বাহী কর্মকর্তা আবুল হায়াত এবং কালাই উপজেলার সাবেক নির্বাহী কর্মকর্তা শামিমা আক্তার জাহান। তারা সবাই আইভিএ কমিটির সাবেক সভাপতি ছিলেন।
অন্য আসামিরা হলেন, ‘সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিস (এসডিএস)’ এর নির্বাহী পরিচালক মোছা. আয়েশা আক্তার, ‘এসো গড়ি, সোনার বাংলা’র নির্বাহী পরিচালক গাউসুল আজম ও সাবেক উপজেলা প্রকল্প ব্যবস্থাপক মোখছেদ আলী; কালাই উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার ও ইন্ডিপেনডেন্ট ভেরিফিকেশন এজেন্সি (আইভিএ) কমিটির সাবেক সদস্য সচিব কাজী মো. মনোয়ারুল হাসান, কালাই উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসার ও আইভিএ কমিটির সাবেক সদস্য হাসান আলী, নাটোর সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ও আইভিএ কমিটির সাবেক সদস্য নীলিমা জাহান, গোমস্তাপুর উপজেলা সহকারী মৎস্য কর্মকর্তা ও আইভিএ কমিটির সাবেক সদস্য আনোয়ার আলী, কালাই উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ও আইভিএ কমিটির সাবেক সদস্য অরুণ চন্দ্র রায় ও কালাই উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ও আইভিএ কমিটির সাবেক সদস্য তৌহিদা মোহতামিম।
যে কারণে দায়ের করা হয় মামলাটি :
জানা যায়, জয়পুরহাটের কালাই উপজেলায় প্রাথমিকে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের একটি প্রকল্পে ১ হাজার ৩৫৬ জন শিক্ষার্থী দেখানো হলেও রেকর্ডপত্র বিশ্লেষণে দুদকে পেয়েছে মাত্র ১১ জন। অথচ এই বিষয়ে কোনো আপত্তি না জানিয়ে ওই প্রকল্পের কার্যক্রম সন্তোষজনক বলে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়।
এর মাধ্যমে সরকারের ৩ কোটি ৫৫ লাখ ৮৭ হাজার ৪৩২ টাকা আত্মসাৎ করা হয়।
২০২০ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর এ সময়ের মধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি (পিইডিপি-৪) এর সাব-কম্পোনেন্ট ২.৫ প্রকল্পে এ ঘটনা ঘটেছে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৮-১৪ বছর বয়সী ঝরে পড়া ও বিদ্যালয়ে ভর্তি না হওয়া শিক্ষার্থীদের যাচাই-বাছাই না করে, প্রকৃত ঝরে পড়া ও বিদ্যালয় বহির্ভূত শিক্ষার্থী না নিয়ে ১ হাজার ৬৫৭ জন ভুয়া ঝরে পড়া ও বিদ্যালয় বহির্ভূত শিক্ষার্থী উপস্থিত দেখানো হয়। তাদের নিয়ে ৫৫টি ভুয়া উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয় (উপানুষ্ঠানিক শিখনকেন্দ্র) প্রতিষ্ঠা দেখানো হয়। ভুয়া শিক্ষার্থীদের নামে বিভিন্ন খরচ দেখিয়ে ভুয়া দলিল তৈরি করা হয়।
শিক্ষার্থীদের জরিপ তালিকায় ক্যাম্পেইন কমিটির সভাপতি অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট ক্যাচমেন্ট এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের প্রত্যয়ন/এনওসি থাকা বাধ্যতামূলক থাকার পরও সভাপতির প্রত্যয়ন ব্যতীত-ই শিক্ষার্থীদের তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে পরিদর্শন ও ভ্যালিডেশন কার্যক্রমে কোনো আপত্তি না জানিয়ে ওই প্রকল্পের কার্যক্রম সন্তোষজনক মর্মে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে।
জরিপের রেকর্ডপত্র পর্যালোচনায় দুদক জানায়, ঝরে পড়া শিক্ষার্থী দেখানো হয়েছে ১ হাজার ৩৫৬ জন, অথচ রেকর্ডপত্র বিশ্লেষণে, কালাই উপজেলায় ঝরে পড়া শিক্ষার্থী মাত্র ১১ জন পাওয়া গেছে। এই বিষয়ে কোনো আপত্তি না জানিয়ে ওই প্রকল্পের কার্যক্রম সন্তোষজনক বলে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। পিইডিপি-৪ এর সাব কম্পোনেন্ট ২.৫ আউট অব চিলড্রেন এডুকেশন কার্যক্রমের শিখন কেন্দ্র মাঠ পর্যায়ে ভ্যালিডেশন ও কমপ্লায়েন্স রিপোর্ট বা প্রতিবেদন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের প্রতিবেদন ছাড়া উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর যথাযথ কর্তৃপক্ষ কোনো বিলের অর্থ ছাড় অনুমোদন করেন না। অথচ তিনিসহ তাদের কমিটি এসব বিষয় যাচাই বাছাই ছাড়াই সমস্ত কার্যক্রম সন্তোষজনক বলে প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। এছাড়াও, পরবর্তী ইন্ডিপেনডেন্ট ভেরিফিকেশন এজেন্সি কমিটির জান্নাত আরা তিথি, আবুল হায়াত, শামিমা আক্তার জাহান, অরুণ চন্দ্র রায়, তৌহিদা মোহতামিম বিধিমালা অনুযায়ী, উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয় (উপানুষ্ঠানিক শিক্ষনকেন্দ্র) প্রতিটি উপানুষ্ঠানিক বিদ্যালয়, শিক্ষক, সিএমসি সদস্য, শিক্ষা উপকরণ এবং ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীদের যথাযথ ভ্যালিডেশন করার কথা থাকলেও তা ওই কমিটি করেনি। এছাড়া দায়িত্বে চরম অবহেলা, ভুয়া-অগ্রহণযোগ্য রেকর্ডপত্র তৈরিতে সহযোগিতা ও ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন তারা।
তিন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ও এক ইউএনও ইন্ডিপেনডেন্ট ভেরিফিকেশন এজেন্সি (আইভিএ) কমিটির সভাপতি ছিলেন। অভিযোগের বিষয়ে গত ১৫ ডিসেম্বর টুকটুক তালুকদার সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার স্বাক্ষরে কোনো টাকা তো যায়নি। উপজেলায় মনিটরিং টিমে ছিলাম শুধু। দুদক তো আমাকে আসামি করার কথা নয়। সাক্ষী করেছে কিনা, ভালো করে দেখুন।’
শামিমা আক্তার জাহান বলেন, ‘কালাই উপজেলায় আমি যোগ দেওয়ার আগেই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল। আমি ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের ১১ সেপ্টেম্বর কালাইতে যোগ দিয়েছিলাম। আগের ইউএনও স্যারের রিপোর্ট অনুযায়ী আমি শুধু প্রকল্প সমাপনী প্রত্যয়ন প্রতিবেদনে স্বাক্ষর করেছি। দুদক আমার কোনো বক্তব্য নেয়নি।’
জান্নাত আরা তিথি বলেন, ‘দুদকের মামলার বিষয়ে আমি কিছু জানি না। দুদক বলতে পারবে কেন আমাকে আসামি করছে।’
অপর আসামি আবুল হায়াত কল রিসিভ না করায় তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
তথ্য সূত্র : দৈনিক শিক্ষা ডটকম

আপনার মতামত লিখুন
Array