ক্ষমতাচ্যুত সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে ব্যাংক খাতে বেপরোয়া লুটপাটে সৃষ্ট ক্ষত কৌশলে আড়াল করে রাখা হয়েছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়ে এই ক্ষতে প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টা ছিল। এতে হিতে-বিপরীত হয়েছে। লুট হয়েছে ছাপানো টাকাও। বেড়েছে তারল্য ও ডলার সংকট; মূল্যস্ফীতির পারদ হয়েছে ঊর্ধ্বমুখী। অর্থনৈতিক মন্দা থেকে সৃষ্ট জনরোষ ও কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে আওয়ামী আমলের লুটপাটের ঘটনা তদন্ত শুরু করলে ভয়াবহ চিত্র বেরিয়ে আসতে থাকে। এখন পর্যন্ত ব্যাংক খাত থেকে প্রায় ৫ লাখ কোটি টাকা নিয়ে গেছে লোপাটকারীরা। এর বড় অংশই পাচার করা হয়েছে। এসব অর্থ এখন খেলাপি হচ্ছে। আওয়ামী লীগের লুটপাটের কারণে বর্তমান সরকারের এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে তিন লাখ কোটি টাকার বেশি। মোট খেলাপি দাঁড়িয়েছে পাঁচ লাখ কোটি টাকার বেশি। এতে গত এক বছরে ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট ছিল প্রকট। ছোট-বড় অনেক ব্যাংক থেকে গ্রাহকরা নিয়মিত টাকা তুলতে পারেননি। যা এখনো অব্যাহত। সবমিলিয়ে আলোচ্য সময়ে টাকার জন্য একরকম হাহাকার পড়েছিল ব্যাংক খাতে।
তবে আশার কথা-বর্তমান সরকারের নেওয়া নানা পদক্ষেপে বন্ধ হয়েছে ব্যাংক খাতে নতুন লুটপাট। ব্যাংকগুলোকে অনৈতিক সুবিধা দেওয়ার প্রবণতাও বাতিল করা হয়েছে। পাচার করা টাকা উদ্ধারে নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন পদক্ষেপ। দেশ ও বিদেশে কয়েকজন পাচারকারীর সম্পদ জব্দ করা হয়েছে। ব্যাংক খাতকে পুনরুদ্ধার করার জন্য নেওয়া হয়েছে বহুমুখী কার্যক্রম। এর সুফল আসতে একটু সময় লাগবে বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে লুটপাট ও পাচার বন্ধ হওয়ায় ইতোমধ্যে ব্যাংক খাতে তারল্যের জোগান বাড়তে শুরু করেছে। দুর্বল ব্যাংকগুলো ঘুরে দাঁড়াচ্ছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে লুটপাটের কারণে এখন পর্যন্ত প্রায় ৫ লাখ কোটি টাকা ব্যাংক থেকে বের করে নেওয়া হয়েছে বলে তদন্তে উঠে এসেছে। এর বড় অংশই বিদেশে পাচার করা হয়েছে। ফলে এসব টাকা ব্যাংকে নেই। আইএমএফের মতে, ব্যাংক খাত পুনরুদ্ধার করতে কমপক্ষে ৪ লাখ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে একীভূতকরণের তালিকায় থাকা ৫টি ব্যাংককে সচল করতে আগামী এক বছরের মধ্যে ২ লাখ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে।
লুটপাটের টাকা সবই খেলাপি হচ্ছে। যে কারণে আশঙ্কা করা হচ্ছে খেলাপি ঋণ শিগগিরই ৫ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। তবে অবলোপন ও আদালতের স্থগিতাদেশের করণে অনেক ঋণ খেলাপি হলেও তা অফিশিয়ালি দেখানো যাচ্ছে না। এগুলো যোগ হলে খেলাপি সাত লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেন, ব্যাংক খাতে এখন খেলাপি ঋণের সব তথ্য দেখানো হচ্ছে না। পাশাপাশি অবলোপন করা ঋণও খেলাপির হিসাবে নেই। কিন্তু সেগুলোও খেলাপি। অবলোপন করা এই ঋণের অঙ্ক প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা। আদালতের মামলা ও অন্যান্য স্থগিতাদেশের কারণে এবং কিছু খেলাপি ঋণের তথ্য ব্যাংকগুলো গোপন করায় প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকা খেলাপি হিসাবে দেখানো হচ্ছে না। অথচ সেগুলোও খেলাপি। এসব মিলে বহু আগেই খেলাপি ঋণ ৭ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, গত এক বছরে ব্যাংক খাতে নগদ টাকার অভাব ছিল প্রকট। এর নেপথ্যে কয়েকটি কারণ শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে-কিছু ব্যাংক দখল করে লুটপাট, ঋণ জালিয়াতির কারণে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি, গ্রাহকদের আস্থার অভাবে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেওয়া, কয়েকটি ব্যাংককে বিগত সরকারের সময়ে দেওয়া অনৈতিক সুবিধা প্রত্যাহার করায় ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট বেড়েছে।
ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার উত্তরাধিকার সূত্রে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অব্যাহত ক্ষয়, প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসনে ভয়াবহ পতনের মাধ্যমে একটি ভঙ্গুর ব্যাংকিং খাত এবং একটি সংকীর্ণ অর্থায়ন ব্যবস্থা পেয়েছে।
ভঙ্গুর ব্যাংক খাতকে সচল করতে ব্যাপক সংস্কারের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে সুশাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ চলমান রয়েছে। ব্যাংকগুলো যাতে দৈনন্দিন কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারে সেজন্য নীতি সহায়তা অব্যাহত রাখা হয়েছে।
সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিদায়ি অর্থবছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা হিসাবে ১২ লাখ কোটি টাকার বেশি প্রদান করেছে। এর মধ্যে ৮৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকাই দেওয়া হয়েছে শরিয়াহভিত্তিক ইসলামী ব্যাংকগুলোকে। এছাড়া তারল্য ঘাটতি রয়েছে এমন ব্যাংকগুলোকে সহায়তা করাতে আন্তঃব্যাংক লেনদেনের জন্য একটি ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিমের অধীনে ১১ হাজার ১০০ কোটি টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মে পর্যন্ত এই স্কিমের আওতায় নেওয়া ঋণের মধ্যে বকেয়ার পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। বাকি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। দৈনন্দিন কার্যক্রমের চাহিদা মেটাতে সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোকে ৩৩ হাজার কোটি টাকার বিশেষ তারল্য সহায়তা প্রদান এবং অতিরিক্ত আরও সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে।
লুটপাটের কারণে ব্যাংক খাতকে বিগত সরকার খাদের কিনারে নিয়ে গিয়েছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে চলতি হিসাবে স্থিতি কোনো ব্যাংকের ঘাটতি হতে পারবে না। ঘাটতি হলেই বুঝতে হবে ওই ব্যাংকে ভয়াবহ সংকট রয়েছে। লুটপাটের শিকার ব্যাংকগুলোর ২০২২ সালের নভেম্বর থেকে ওই চলতি হিসাবে ঘাটতি দেখা দেয়। তারপরও কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। অনৈতিক সুবিধা দিয়ে তা আড়াল করে রেখেছিল। বর্তমান গভর্নরও দায়িত্ব নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে চলতি হিসাবে ঘাটতি সমন্বয়ের উদ্যোগ নেন। এর মধ্যে কয়েকটি ব্যাংক নিজেরাই ঘাটতি সমন্বয় করতে সক্ষম হয়েছে। বাকি কয়েকটি ব্যাংক এখনো ঘাটতিতে আছে। এসব ব্যাংককে জুনে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে থাকা চলতি হিসাবের স্থিতির ঘাটতি মোকাবিলায় প্রায় সাড়ে ১৯ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে।
ব্যাংক খাতকে পুনরুদ্ধারের জন্য তিনটি বিশেষায়িত টাস্কফোর্স গঠন করেছে। এর মধ্যে ব্যাংক খাত সংস্কার টাস্কফোর্স প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণ কাঠামো শক্তিশালী করা, সম্পদের মান উন্নত করা এবং কার্যকর ব্যাংক ব্যবস্থা গঠনের জন্য একটি কাঠামোগত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছে।
বৃহত্তর প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের অংশ হিসাবে বাংলাদেশ ব্যাংক মার্চ মাসে ব্যাংক খাত পুনর্গঠন এবং সমস্যা সমাধানে একটি ইউনিট গঠন করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা বাড়ানো এবং সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করছে দ্বিতীয় টাস্কফোর্সটি।
তৃতীয় টাস্কফোর্সটি বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া সম্পদ চিহ্নিত করে তা দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করছে। এ কাজের অংশ হিসাবে বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট সাড়ে ৬ হাজারের বেশি সন্দেহজনক ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে।
ব্যাংক খাতের সংকট চিহ্নিত করে তা সমাধানের জন্য ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ‘ব্যাংকিং সেক্টর ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট কাউন্সিল’ নামে একটি নতুন আন্তঃপ্রাতিষ্ঠানিক সংস্থা গড়ে তোলার পদক্ষেপ নিয়েছে। এই কাউন্সিলের উদ্দেশ্য হবে আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য ব্যাংক খাতে সংকটের পাশাপাশি আশপাশের পদ্ধতিগত সংকটের (রাজনৈতিক, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নানা অসন্তোষে কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হওয়া) প্রভাব কার্যকরভাবে মোকাবিলা করা এবং প্রশমিত করা। এটি দেশে-বিদেশে বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে ব্যাংক খাতের সম্ভাব্য ঝুঁকি আগাম চিহ্নিত করে সমাধানের প্রয়োজনীয় সুপারিশ করবে। এছাড়া একটি সেতু বা ব্রিজ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে সংকটে পড়া ব্যাংকগুলোকে পুনরুদ্ধারে সহায়তা করা হবে।
ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের চাপ কমাতে ঋণ আদায় বাড়ানো, যেসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আছে, কিন্তু অচল সেগুলো সচল করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বিগত সরকার খেলাপি ঋণের তথ্য গোপন করলেও এই সরকার প্রকাশ করে দিচ্ছে। এতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে বিদ্যুৎগতিতে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে লুটের অর্থ এখন খেলাপি হচ্ছে। ফলে খেলাপি ঋণ বেড়ে ৫ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। গত বছরের জুনে খেলাপি ঋণ ছিল ২ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা। এ হিসাবে এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ লাখ কোটি টাকার বেশি। নতুন খেলাপি হওয়া ৩ লাখ কোটি টাকার প্রায় সবই আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে লুট করা অর্থ। যেগুলো আগে খেলাপি করা হয়নি। এখন সেগুলোকে খেলাপি করা হচ্ছে।
খেলাপি ঋণ বাড়ায় ব্যাংকগুলোর প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে। কারণ প্রকৃত আয় কমায় খেলাপি ঋণ বাড়ায় চাহিদা অনুযায়ী প্রভিশন রাখতে পারছে না। প্রভিশন ঘাটতি বাড়ায় বেড়েছে মূলধন ঘাটতি। যে কারণে ব্যাংক খাতে মূলধন ঘাটতি স্মরণকালের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁচেছে।
ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে মূলধন সংরক্ষণের হার ছিল ৩ দশমিক ০৮ শতাংশ। এর আগে ২০০৪ সালে এ হার ছিল ৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ। এর মধ্যবর্তী সময়ে মূলধন রাখার হার বেড়ে ১২ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু লুটপাটের কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ায় এখন মূলধন রাখার হার কমেছে।
সূত্র : দৈনিক যুগান্তর
আপনার মতামত লিখুন
Array