‘দেশে অন্তঃসত্ত্বা ও নতুন মায়েদের মধ্যে বাড়ছে উদ্বেগ ও বিষণ্নতা’
দেশে নারীদের মানসিক রোগে আক্রান্ত হওয়ার হার পুরুষদের তুলনায় বেশি। অন্তঃসত্ত্বাকালীন ও প্রসবোত্তর সময়ে এই ঝুঁকি বেড়ে যায়। সম্প্রতি আইসিডিডিআর,বি-র অ্যাডসার্চ প্রকল্পের গবেষণায়, বাংলাদেশে অন্তঃসত্ত্বা ও প্রসূতি নারীদের মানসিক স্বাস্থ্যের উদ্বেগজনক চিত্র উঠে এসেছে। মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর আইসিডিডিআর,বি-র সাসাকাওয়া অডিটোরিয়ামে অ্যাডসার্চ প্রকল্পের ‘এনহ্যানসিং অ্যাক্সেস টু মেন্টাল হেলথ সার্ভিস থ্রু টেলিমেডিসিন হেলথ সার্ভিস অ্যাট ওয়েলবিং সেন্টার ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণার ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে গবেষকরা এসব তথ্য তুলে ধরেন। গর্ভাবস্থায় এবং সন্তান জন্মের পর ৭৭ শতাংশ নারী বিষণ্ণতা কিংবা উদ্বেগজনিত সমস্যায় আক্রান্ত হন। এদের মধ্যে ৬৬ শতাংশ নারী একইসঙ্গে এই দুই সমস্যার মুখোমুখি হন।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ২০২১ সালের হিসেব অনুযায়ী সারা বিশ্বে ৯৭ কোটির (৯৭০ মিলিয়ন) বেশি মানুষ কোনও না কোনোভাবে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন। এর মাঝে প্রায় ২৪ কোটি (২৪০ মিলিয়ন) ব্যক্তিই বাস করেন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে। বাংলাদেশে ঠিক কত সংখ্যক মানুষ মানসিক সমস্যায় ভুগছেন— এর একটি ধারণা পাওয়া যায় ২০১৯ সালের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপে। যেখানে দেখা গিয়েছিল, দেশের অন্তত ১৯ শতাংশ মানুষ মানসিক রোগে ভুগছেন। বাংলাদেশে প্রয়োজনের তুলনায় মানসিক চিকিৎসকের সংখ্যা একেবারেই অপ্রতূল। দেশে মানসিক চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র ২৬০ জন। অর্থাৎ প্রতি ১০ লাখ মানুষের জন্য ২ জনেরও কম ডাক্তার। দেশে মনোবিজ্ঞানী রয়েছে ৫৬৫ জন, অর্থাৎ প্রতি ১০ লাখ মানুষের জন্য ৪ জনেরও কম। এদের বেশিরভাগ আবার শহর এলাকায় থাকেন। এর ফলে, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে সরাসরি মানসিকসেবা প্রদান করা খুবই চ্যালেঞ্জের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আইসিডিডিআরবি জানায়, এই গবেষণার আওতায় ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে এই বছরের জুলাই পর্যন্ত ঢাকার বাইরে, দেশের ৭টি জেলা হাসপাতাল ও উপজেলা সদর হাসপাতালের ৭ হাজার ৫০০ জনকে পর্যবেক্ষণ করা হয়, যার মধ্যে সেবা গ্রহণকারী ছিলেন ৫ হাজার ৬০০ জন নারী। বিষণ্ণতায় আক্রান্ত নারীদের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী কোন দুঃখবোধ, ঘুমের ব্যাঘাত, কাজের আগ্রহ ও আনন্দ হারানো, ক্লান্তি, নিজেকে দোষারোপ, খাবারে অরুচি, মনোযোগের অভাব এবং কখনও কখনও আত্মহত্যার চিন্তা ইত্যাদি লক্ষণ পাওয়া গেছে। অপরদিকে উদ্বেগের সাধারণ লক্ষণগুলোর মধ্যে ছিল স্নায়বিক অস্থিরতা, নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভয়, অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা, হঠাৎ ভয় পাওয়া ও অস্থিরতা।
যে ৭ হাজার ৫০০ জনকে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে— তারা অ্যাডসার্চ প্রকল্পের মনস্বাস্থ্য কেন্দ্র বা ওয়েলবিং সেন্টার থেকে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিয়েছিলেন।
অ্যাডসার্চ পরিচালিত বাস্তবায়নাধীন গবেষণা প্রকল্প মনস্বাস্থ্য কেন্দ্র বা “ওয়েলবিয়িং সেন্টার” উদ্যোগটি একটি আশাব্যঞ্জক উদাহরণ। ৭টি কেন্দ্রের প্রেক্ষাপটে পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় সব স্বাস্থ্যকর্মী এই সেবার বাস্তবায়নকে কার্যকর ও সম্ভাবনাময় মনে করেছেন। একইসঙ্গে ১ হাজার ৯ জন অন্তঃসত্ত্বা ও প্রসবোত্তর নারী এই সেবাকে গ্রহণযোগ্য, উপকারী এবং নিরাপদ বলে মূল্যায়ন করেছেন।
গবেষণায় ব্যবহৃত মানসিক স্বাস্থ্য নির্ণায়ক দুটি গবেষণা পদ্ধতি থেকে উঠে এসেছে, কাউন্সেলিং সেশনের ফলে বিষণ্ণতা ও উদ্বেগের লক্ষণ উল্লেখযোগ্য ভাবে হ্রাস পেয়েছে। গর্ভকালীন সময়ে মহিলারা মনস্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে গিয়ে ভিডিওকনফারেন্স কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে মনোবিজ্ঞানী ও মানসিক চিকিৎসকদের থেকে ব্যক্তিগত ও বিশেষায়িত সেবা লাভ করতে পারছেন। সেবা গ্রহণকারী স্বাস্থ্যকর্মীরাও উদ্যোগটিকে কার্যকর ও সম্ভাবনাময় বলে মনে করেন।
প্রজনন বয়সী নারীদের মানসিক স্বাস্থ্য
বাংলাদেশে প্রজনন-বয়সী নারীদের উদ্বেগ ও বিষণ্ণতার লক্ষণ মূল্যায়নের জন্য বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে (বিডিএইচএস)-২০২২ তথ্য ব্যবহার করে পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, ২০ হাজার ২৯ জন প্রজনন বয়সী নারীদের মধ্যে শতকরা ৪ ভাগ মাঝারি থেকে তীব্র উদ্বেগ এবং শতকরা ৫ ভাগ মাঝারি থেকে তীব্র বিষণ্ণতায় ভুগছেন। উল্লেখ্য, বিডিএইচএস ২০২২ সালে প্রথমবারের মতো মানসিক স্বাস্থ্য মডিউল অন্তর্ভূক্ত করেছে। ভৌগলিকভাবে দেখা যায় যে, দূর্যোগপ্রবণ বিভাগগুলো যেমন- খুলনা, রংপুর ও সিলেটের নারীদের মধ্যে উদ্বেগ ও বিষণ্ণতার হার বেশি।
সাইবার বুলিং-এ বড় বিপদ
বাংলাদেশ অ্যাডোলেসেন্ট হেলথ অ্যান্ড ওয়েলবিইং সার্ভে (২০১৯-২০২০) এর ৪ হাজার ৯৮৪ জন কিশোরী নিয়ে পরিচালিত একটি গবেষণায় উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে। বাংলাদেশি কিশোরীদের মধ্যে সাইবার বুলিং ও তীব্র বিষণ্নতার সম্পর্ক নিয়ে এই গবেষণায় দেখা গেছে যে, সাইবার বুলিং কিশোরী নারীদের মানসিক স্বাস্থ্যে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। জরিপে অংশ নেওয়া কিশোরীদের মধ্যে ৮ শতাংশ গত একবছরে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়েছে এবং সামগ্রিকভাবে ১২ শতাংশ কিশোরীর মধ্যে তীব্র বিষণ্নতা রয়েছে
মনস্বাস্থ্য কেন্দ্রকে এগিয়ে নেওয়ার আহ্বান
ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে বিশেষজ্ঞরা মনস্বাস্থ্যের এই মডেল উদ্যোগ বাংলাদেশে অন্তঃসত্ত্বা ও প্রসবোত্তর নারীদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য একটি কার্যকর দৃষ্টান্ত হতে পারে বলে মতামত প্রকাশ করেন। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন আইসিডিডিআর,বি-র মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সিনিয়র ডিভিশন ডিরেক্টর ড. আনিসুর রহমান। বৈজ্ঞানিক সেশনে গর্ভাবস্থায় নারীদের মানসিক স্বাস্থ্য ও সমাধান উপস্থাপন করেন আইসিডিডিআর,বি-র সায়েন্টিস্ট ড. আহমেদ এহসানূর রহমান, ও সহকারী সায়েন্টিস্ট ডা. সাহার রাজা।
দ্বিতীয় সেশনে আইসিডিডিআর,বি-র অ্যাসোসিয়েট সায়েন্টিস্ট আনীকা তাসনিম হোসেন, টেলিমেন্টাল হেলথ সেবার মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করার উপায় তুলে ধরেন।
নারীদের মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব সম্পর্কে অধ্যাপক ডা. সায়েবা আক্তার তার বক্তৃতায় বলেন, ‘মানসিক স্বাস্থ্যকে শারীরিক স্বাস্থ্যের মতো গুরুত্ব দেওয়া হয় না। মহিলাদের ক্ষেত্রে এ সমস্যা আরও ভয়াবহ। জাতি হিসেবে কিংবা অর্থনৈতিক দিক থেকে উন্নতি করতে হলে আমাদের সম্মিলিতভাবে মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দিতে হবে’।
মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কাজী দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘অন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মতো আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যকেও যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। আশার কথা হলো, সরকার এরই মধ্যে মেন্টাল হেলথ অ্যাক্ট, মেন্টাল হেলথ পলিসি প্রণয়ন করেছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আমরা এগুলোকে সবার জন্য কীভাবে স্থায়ীভাবে বাস্তবায়ন করবো, তা নিয়ে ভাবতে হবে।’ তিনি আইসিডিডিআর,বি মনস্বাস্থ্যকেন্দ্র নিয়ে গবেষণা থেকে পাওয়া জ্ঞানকে কাজে লাগানোর আহবান জানান।
ডা. সৈয়দ জাকির হোসেন, লাইন ডিরেক্টর, এনসিডিসি, ডিজিএইচএস এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে বাজেট বৃদ্ধি করতে হবে। ইভিডেন্স নির্ভর মডেলগুলোকে ইউনিয়ন কিংবা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মাধ্যমে মানুষের হাতের নাগালে নিতে হবে। মানুষকে জানাতে হবে এখানে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া যায়’।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ মেন্টাল হেলথ- এর পরিচালক প্রফেসর ডা. মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘সরকার দেশের উপজেলা পর্যায়ের ৬০০ ডাক্তারকে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। তিনি বিপুল জনগোষ্ঠীর মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য মনস্বাস্থ্য কেন্দ্রের টেলি-মেন্টাল সার্ভিসের মতো উদ্যোগ আরও নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন।
গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডার পক্ষ থেকে গবেষণা নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানান এডওয়ার্ড ক্যাবেরা, ফার্স্ট সেক্রেটারি – ডেভেলপমেন্ট (হেলথ), কানাডিয়ান হাইকমিশন, বাংলাদেশ। তিনি আশাবাদ ব্যাক্ত করেন, প্রত্যেক মহিলাই তার প্রয়োজনীয় মানসিক সহায়তা যেন পেতে পারেন এলক্ষ্যে কানাডা সরকার কাজ করে যাবে।
অনুষ্ঠানের সমাপনী বক্তব্য দেন অ্যাডসার্চ প্রজেক্ট ডিরেক্টর ও সিনিয়র সায়েন্টিস্ট ড. শামস এল আরেফিন।

আপনার মতামত লিখুন
Array