মধ্যপ্রাচ্য নেতাদের চরম উপলব্ধির মুহূর্ত

কাতারে ইসরায়েল কর্তৃক আক্রমণ ছিল আরব এবং মুসলিম সরকারগুলোর জন্য একটা চরম সত্য উপলব্ধির মুহূর্ত। কাতারের রাজধানী দোহায় হামাস নেতাদের লক্ষ্য করে ইসরায়েলের আক্রমণ সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য এবং তার বাইরের দেশগুলোকেও কাঁপিয়ে দিয়েছিল।
কাতার ছিল এ অঞ্চলের ষষ্ঠ দেশ, যারা ইসরায়েলি সামরিক আগ্রাসনের মুখোমুখি হয়েছিল। শুধু সেপ্টেম্বর মাসেই ইসরায়েল লেবানন, ফিলিস্তিন, ইয়েমেন, সিরিয়া ও তিউনিসিয়ার বিরুদ্ধে হামলা চালিয়েছিল। কিন্তু কাতারের ওপর বিমান হামলা ছিল উপসাগরীয় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রথম। কাতারকে বলা হয় যুক্তরাষ্ট্রের একটি অ-ন্যাটো বা সামরিক মিত্র। একাধারে প্রায় দুই বছর ধরে ইসরায়েল গাজায় যুদ্ধ এবং গণহত্যা চালিয়ে আসছে, যেখানে ৬৫ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছে।
দোহার ওপর হামলার পর আয়োজিত জরুরি আরব/ইসলামিক শীর্ষ সম্মেলনে ইসরায়েল যেভাবে এই অঞ্চলে হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে, তা থেকে দেশটিকে বিরত রাখার জন্য জোরালো প্রতিক্রিয়া দেওয়া হবে বলে প্রত্যাশা ছিল। আরব লিগ এবং ওআইসির অসাধারণ যৌথ অধিবেশনে বিশ্বের দুই বিলিয়ন মুসলিমের প্রতিনিধিত্বকারী প্রায় ৬০টি দেশের নেতা ও প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
শীর্ষ সম্মেলনের সুর ছিল গম্ভীর ও কঠোর। কাতারের সঙ্গে সংহতি ঘোষণা করে, ইসরায়েলি হামলার নিন্দা করে এবং গাজায় ইসরায়েলের ‘গণহত্যা, জাতিগত নির্মূল, অনাহার ও অবরোধের অপরাধ’ নিন্দা করে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নেয় তারা। এতে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের কাছেই একটি শক্তিশালী বার্তা পৌঁছেছে। কিন্তু শীর্ষ সম্মেলনে ব্যাপকভাবে প্রত্যাশিত কোনো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। দীর্ঘ যৌথ বিবৃতিতে ‘ইসরায়েলকে ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে তাদের কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখতে বাধা দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রগুলোকে সম্ভাব্য সব আইনি এবং কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের’ আহ্বান জানানো হয়েছে। এর মধ্যে কিছু নির্দিষ্ট বিষয় ছিল, যেখানে ‘ইসরায়েলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা, অস্ত্র, গোলাবারুদ এবং সামরিক উপকরণ সরবরাহ, স্থানান্তর বা ট্রানজিট স্থগিত করা, এর সঙ্গে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক পর্যালোচনা করা এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব পৃথক দেশগুলোর ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।’
এ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব পৃথক দেশগুলোর ওপর ছেড়ে দিয়ে শীর্ষ সম্মেলনে কোনো সম্মিলিত পদক্ষেপে সম্মতি জানানো হয়নি, এমনকি যেসব দেশ এখনো ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে, তাদের সম্পর্ক স্থগিত করতে বা ইসরায়েলি বিমানের জন্য তাদের আকাশসীমা বন্ধ করতে বলা হয়নি। এমনকি সবচেয়ে ন্যূনতম রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক পদক্ষেপও নেওয়া হয়নি। বিশাল সম্পদ, বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সরবরাহের এক-চতুর্থাংশেরও বেশি নিয়ন্ত্রণ এবং ভূ-কৌশলগত গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও আরব রাষ্ট্রগুলো কূটনৈতিকভাবে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল।
কিছু নেতা বাস্তব পদক্ষেপের প্রস্তাব করেছিলেন, কিন্তু সেগুলোর কোনোটিই গৃহীত হয়নি। উদাহরণস্বরূপ, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান অর্থনৈতিক চাপ বৃদ্ধির পরামর্শ দিয়েছিলেন, স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন যে এটি অতীতে কাজ করেছিল।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ইসরায়েলি সম্প্রসারণবাদ পর্যবেক্ষণ এবং প্রতিরোধ করার জন্য একটি আরব/ইসলামিক টাস্কফোর্স তৈরির ধারণাটি সামনে রেখেছিলেন। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ‘কঠোর, শাস্তিমূলক পদক্ষেপ’ প্রস্তাব করেছিলেন। ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানসহ অন্যরা দেশগুলোকে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার আহ্বান জানিয়েছেন।
কিছু আরব বিশ্লেষকের মতে, উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের অর্থাৎ ওআইসির ‘একটি যৌথ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় করার’ পরিকল্পনাই সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ হতো। জিসিসি সদস্যদের একটি যৌথ প্রতিরক্ষা চুক্তি রয়েছে, যার অধীনে একজন সদস্যের ওপর আক্রমণ সবার ওপর আক্রমণ হিসেবে বিবেচিত হবে। তারা যৌথ নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য অনেক পদক্ষেপের পরিকল্পনা করে। এটি একটি কার্যকর যৌথ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করে কি না, তা এখনো দেখা যায়নি। তবে, শীর্ষ সম্মেলনের কয়েক দিন পর ঘোষিত পাকিস্তান-সৌদি প্রতিরক্ষা চুক্তির দ্বারা এর তাৎপর্য ম্লান হয়ে গেছে।
কাতারের ওপর ইসরায়েলি হামলার প্রতিক্রিয়া স্পষ্ট। এটি গাজায় যুদ্ধবিরতির সূক্ষ্মতম সম্ভাবনাকেও দূর করে দিয়েছে। হামাসের আলোচক দলের সদস্য, যারা যুদ্ধবিরতির জন্য একটি নতুন মার্কিন প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করতে জড়ো হয়েছিল। ইসরায়েল তাদের লক্ষ্যবস্তু করেছিল, যা তেল আবিবের শান্তি আলোচনায় আগ্রহের অভাব তুলে ধরে।
কাতারের শাসক শেখ তামিম আল থানি শীর্ষ সম্মেলনে যেমন বলেছিলেন, মধ্যস্থতাকারীদের ওপর হামলা প্রমাণ করে যে, ইসরায়েলের ‘শান্তিতে প্রকৃত আগ্রহ নেই’ এবং তারা ‘আলোচনা ব্যর্থ করতে’ চাইছে। যদিও ইসরায়েলি হামলায় হামাসের শীর্ষ নেতাদের হত্যা করা সম্ভব হয়নি, তবুও প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যেখানেই হামাস নেতাদের পাওয়া যাবে, সেখানে আরও হামলার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
তেল আবিব সফরের পর দোহা যাওয়ার পথে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেছেন, ওয়াশিংটন চায় কাতার মধ্যস্থতার ভূমিকা পালন করে যাক কিন্তু যুদ্ধবিরতির জন্য সময় ফুরিয়ে আসছে। বিদ্রূপাত্মক বিষয় হলো, দোহায় হামলা বা হামলার নিন্দা করা থেকে ইসরায়েলকে থামাতে যুক্তরাষ্ট্র কিছুই করেনি। গাজা যুদ্ধবিরতির জন্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রই একমাত্র বাধা, যারা যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব ঠেকাতে ভেটো ব্যবহার করেছে। গত সপ্তাহে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এটি ছিল ষষ্ঠ ভেটো, যদিও কাউন্সিলের অন্য সব সদস্য শান্তির পক্ষে ভোট দিয়েছেন।
প্রকৃতপক্ষে, দোহায় ইসরায়েলি হামলার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের কারণে মার্কিন বিশ্বাসযোগ্যতা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যদি তাদের নিকটতম মিত্র এ অঞ্চলে বৃহত্তম আমেরিকান সামরিক ঘাঁটি স্থাপনকারী এবং ট্রাম্প যার সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক দাবি করেন এমন অন্য কোনো রাষ্ট্রকে আক্রমণ করতে পারে, তবে এটি এ অঞ্চলে নিরাপত্তা প্রদানকারী হিসেবে মার্কিন ভূমিকার প্রতি আস্থা জাগায় না। যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে আটকাতে অক্ষম বা অনিচ্ছুক প্রমাণিত হওয়ায় মার্কিন প্রতিরক্ষা ছাতার ওপর নির্ভরশীল রাষ্ট্রগুলো এরই মধ্যে নিরাপত্তা অংশীদারত্বের মূল্য বা নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।
কাতারের জন্য শিক্ষাটিও স্পষ্ট। ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি এবং তাকে একটি বোয়িং উপহার দিয়ে ট্রাম্পের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করা তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে না। তোষামোদ কোনো নিরাপত্তা গ্যারান্টার নয়।
পাকিস্তান এবং সৌদি আরবের মধ্যে সম্প্রতি স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক কৌশলগত পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তিকে এমন প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করতে হবে। এ চুক্তি মধ্যপ্রাচ্যে একটি মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার সময় এনেছে। কাতারে ইসরায়েলি হামলার কয়েক মাস আগে নিরাপত্তা চুক্তির জন্য আলোচনা হয়েছিল। পাকিস্তান-সৌদি আরব প্রতিরক্ষা চুক্তি তাই ভূরাজনৈতিক গতিশীলতা এবং জোট পরিবর্তনের আরেকটি লক্ষ্য। কিন্তু চুক্তির বিষয় ঘোষণার সময় ইঙ্গিত দেওয়া হয় যে, উপসাগরীয় দেশটির ওপর আক্রমণ এবং এ অঞ্চলে ইসরায়েলের অনিয়ন্ত্রিত আগ্রাসন চুক্তি স্বাক্ষরকে ত্বরান্বিত করেছে, রিয়াদ তার নিরাপত্তা অংশীদারত্বকে বৈচিত্র্যময় করতে চাইছে এবং পাকিস্তান তার বিকল্পগুলো প্রসারিত করছে। ঐতিহাসিক চুক্তির অধীনে উভয় দেশই একটির ওপর আক্রমণকে ‘উভয়ের বিরুদ্ধে আগ্রাসন’ হিসেবে বিবেচনা করবে।
যদিও চুক্তির সুদূরপ্রসারী প্রভাব মূল্যায়ন একটি পৃথক বিষয়, তথাপি উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এই চুক্তিটি যুক্তরাষ্ট্রের ওপর উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর ক্ষয়িষ্ণু আস্থার প্রতিফলন, যা অপ্রত্যাশিত ছিল। ইসরায়েলের প্রতি অন্ধ সমর্থন তাদের নিরাপত্তা হুমকিকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
অতএব, সৌদিরা একটি কৌশল অনুসরণ করছে এবং ‘যে কোনো আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যৌথ প্রতিরোধের’ জন্য পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকছে। এটি ভূ-কৌশলগত গতিশীলতা ও পরিবর্তনশীল জোটের আরেকটি ইঙ্গিত, যা আজ আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক দৃশ্যপটকে মৌলিকভাবে পুনর্গঠিত করছে।
লেখক: পাকিস্তানি কূটনীতিক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং জাতিসংঘে পাকিস্তানের সাবেক প্রতিনিধি। লেখাটি পাকিস্তানের ইংরেজি সংবাদপত্র দ্য ডন-এর মতামত বিভাগ থেকে ভাষান্তর করেছেন মেজর (অব.) নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ, পিএইচডি
আপনার মতামত লিখুন
Array