ফরিদপুরের পদ্মার চরাঞ্চলে নিরাপদ সবজি চাষে নতুন দিগন্ত
পরিবেশবান্ধব কৃষিপ্রযুক্তি ও এগ্রো ইকোলজিক্যাল চাষ পদ্ধতি সম্প্রসারণের মাধ্যমে ফরিদপুরের চরাঞ্চলের কৃষকদের নিরাপদ সবজি উৎপাদন বেড়েছে। উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে এনে যথাসময়ে বাজারজাত করায় আয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে একদিকে যেমন স্থানীয় কৃষকরা রাসায়নিকনির্ভরতা কমিয়ে জৈব পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদনে দক্ষ হচ্ছেন, অন্যদিকে বাজারে নিরাপদ ও মানসম্মত সবজি সরবরাহ হচ্ছে।
জেলার সদর ও চরভদ্রাসন উপজেলার ডিক্রিরচর ও গাজীরটেক ইউনিয়ন। এ দুটি ইউনিয়নই মূলত পদ্মা নদীতীরবর্তী প্রাকৃতিক চরাঞ্চল। প্রতিবছর বন্যা, ভাঙন, মৌসুমি বৃষ্টিপাত ও নদীর গতি-প্রকৃতির পরিবর্তনে এখানকার কৃষিজমি ও মানুষের জীবনে অনিশ্চয়তা লেগেই থাকে। নদীর চরে গড়ে ওঠা এই এলাকাগুলোর কৃষকদের জীবিকা নির্ভর করে মূলত মৌসুমি ফসলের ওপর। কিন্তু অবকাঠামোর সীমাবদ্ধতা, দুর্বল যোগাযোগ ব্যবস্থা, আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তি ও বাজারজাতকরণ জ্ঞানের অভাব, পুষ্টি ও স্বাস্থ্য সম্পর্কে স্বল্প ধারণা– সব মিলিয়ে এ অঞ্চলের কৃষি উৎপাদন ছিল অনেকাংশেই পশ্চাৎপদ ও ঝুঁকিপূর্ণ। এ অবস্থায় ২০২৪ সালের জুনে স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থা আমরা কাজ করি (একেকে), পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ), ইফাদ এবং ডানিডার সহযোগিতায় চরাঞ্চলের কৃষি ব্যবস্থাকে টেকসই ও পরিবেশবান্ধব করার লক্ষ্যে চালু করে ‘চরাঞ্চলে এগ্রো ইকোলজিক্যাল ফার্মিং পদ্ধতিতে মিশ্র ও আন্তঃফসল চাষের মাধ্যমে নিরাপদ সবজি উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ’ শীর্ষক ভ্যালু চেইন উপপ্রকল্প।
এটি শুধু একটি কৃষি উদ্যোগ নয়, বরং এটি একটি সমন্বিত সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিবর্তনের মডেল। প্রকল্পের প্রত্যক্ষ প্রভাব দেখা যাচ্ছে কৃষকদের আয়, মাটির উর্বরতা, উৎপাদন ব্যয়, উদ্যোক্তা উন্নয়ন ও বাজার সংযোগে। ফরিদপুরের চরাঞ্চল এখন একটি নতুন কৃষি সম্ভাবনার ক্ষেত্র, যেখানে জৈব পদ্ধতিতে উৎপাদিত সবজি দেশের বাজারে নিরাপদ খাদ্য হিসেবে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
১৬ মাস আগে এক হাজার ১৫০ জন ক্ষুদ্র, প্রান্তিক, মধ্যম ও উচ্চ পর্যায়ের চাষিকে অন্তর্ভুক্ত করে মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু হয়। কৃষকদের জন্য বিভিন্ন দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণে এগ্রো ইকোলজিক্যাল পদ্ধতি, মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা, জৈব সার ও জৈব বালাইনাশক প্রস্তুত, মিশ্র ও আন্তঃফসল চাষ পদ্ধতি, বাজারজাতকরণ ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন বিষয়ে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। ১০০ কৃষকের মাটি পরীক্ষা করে তাদের জমির জন্য উপযুক্ত ফসল নির্বাচন ও সার প্রয়োগের পরামর্শ প্রদান করা হয়।
কৃষকদের জৈব সার উৎপাদনে উৎসাহিত করতে পদ্মা নদীর দুর্গম চরাঞ্চলের ওই দুটি ইউনিয়নে ১৫টি কেঁচো সার প্লান্ট ও ছয়টি টাইকো কম্পোস্ট ইউনিট স্থাপন করা হয়েছে। সেচের জন্য ছয়টি সোলার প্যানেলচালিত সেচ ব্যবস্থা ও ৪০টি ডিজেলচালিত পাম্প বসানো হয়েছে সেখানে। পাশাপাশি সবজি চারা উৎপাদনের জন্য নেট হাউস ও চারা উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। প্রকল্পের মাধ্যমে এখন অনেক কৃষকই জৈব ও এগ্রো ইকোলজিক্যাল পদ্ধতিতে কৃষি চর্চা করছেন।
গত ১০ নভেম্বর সরেজমিন দেখা যায়, ডিক্রিরচর ও গাজীরটেক ইউনিয়নের চরের বিভিন্ন গ্রামে কৃষকরা মিশ্র ও আন্তঃফসল চাষে সফলতা অর্জন করেছেন। কিষানি রাহেলা বেগম বলেন, আগে আমরা বুঝতাম না কোন সার বা কীটনাশক কতটুকু ব্যবহার করা দরকার। এখন প্রশিক্ষণ পেয়েছি, বাড়িতেই কেঁচো সার তৈরি করি, জৈব বালাইনাশক বানাই। এতে মাটি উর্বর থাকে, ফসলও ভালো হয়। আগে শুধু খরচ হতো, এখন আয় হচ্ছে।
কৃষক সাগর মিয়া বলেন, আমি এখন কোকোপিটে সবজি চারা উৎপাদন করি। এতে মানসম্মত চারা তৈরি হয়, যা অন্য কৃষকদের কাছে বিক্রি করি। এতে নিজস্ব আয়ের পাশাপাশি অন্য কৃষকরাও ভালো ফল পাচ্ছেন। একসময় ভাবতাম চর থেকে কেউ ব্যবসা করতে পারে না, এখন পারছি।
প্রকল্পের কোঅর্ডিনেটর ফুয়াদ হোসেন বলেন, এই প্রকল্পের সরাসরি সহায়তায় চরাঞ্চলের কৃষকদের মধ্যে মৌলিক পরিবর্তন এসেছে। প্রায় ৭০ শতাংশ কৃষকের আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষকরা এখন পরিমিত রাসায়নিক সার ব্যবহার করছেন এবং জৈব সার ও জৈব বালাইনাশক ব্যবহারে দক্ষ হয়েছেন।
তিনি আরও জানান, ৪০ শতাংশ কৃষক ও উদ্যোক্তার সবজি উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে; উচ্চমূল্যের সবজি ও আগাম ফসল উৎপাদনে তারা দক্ষ হয়েছেন। উৎপাদন ব্যয় ১৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে সোলার সেচ, কম খরচে ডিজেল ইঞ্জিন এবং জৈব সার ব্যবহারের কারণে। বাজারে নিরাপদ সবজি বিক্রয় ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে পাঁচটি আউটলেট ও ভ্রাম্যমাণ বিক্রয়কেন্দ্রে জৈব সবজি বিক্রি হচ্ছে।
আমরা কাজ করির (এ.কে.কে) নির্বাহী পরিচালক এম এ জলিল বলেন, পিকেএসএফ, ইফাদ ও ডানিডার এই সহযোগিতায় চরের কৃষি ব্যবস্থায় এক নতুন অধ্যায় সূচিত হয়েছে।
পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) উপব্যবস্থাপনা পরিচালক আকন্দ মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেন, এগ্রো ইকোলজিক্যাল ফার্মিং চর্চার মাধ্যমে কৃষকরা যেমন প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করছেন, তেমনি নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে অবদান রাখছেন। এটি একটি টেকসই উন্নয়নের দৃষ্টান্ত, যা দেশের অন্যান্য চরাঞ্চলেও সম্প্রসারণযোগ্য।

আপনার মতামত লিখুন
Array