গিটার হাতে মেয়েটি

বসবার ঘর। আয়তনে চল্লিশ বাই পঞ্চাশ ফিট। বাইরে থেকে ঘরে ঢোকার দরোজা এখন বন্ধ। নীল পর্দা ঝুলছে। বসবার ঘর থেকে ভেতরে যাওয়ার দরজা দেখা যাচ্ছে, সেখানেও নীল পর্দা। দরজাটা ভেজানো। ঘরের ডানদিকে একটা জানালা। রিং দিয়ে নীল রঙের পর্দা রডের সঙ্গে লাগানো। জানালার কপাট বাইরের দিকে খোলা, সূর্যের আলো ঘরের পর্দার ভেতর দিয়ে ফিল্টার হয়ে আসছে। মাঝে মাঝে বাতাসে পর্দা ভেতরের দিকে ফুলে উঁচু হলে আলোর মাত্রা বেড়ে উজ্জ্বল দেখাচ্ছে জানালার কাছের জায়গাটা। রোদের তেজ দেখে বোঝা যায় এখন সকাল। বাইরের আলো ভেতরের দিকে ক্রমে আবছা হয়ে এসেছে।
জানালার ওপাশ থেকে গাড়ি আর রিকশা চলাচলের শব্দ শোনা যাচ্ছে মাঝে মাঝে। গাড়ির হর্নের পাশাপাশি রিকশার বেল বাজছে ক্রিং ক্রিং শব্দে। জানালার ওপাশের রাস্তায় মানুষের গলার স্বর উঠছে, নামছে।
ঘরের ভেতরের দরজা বাদ দিয়ে তিনদিকে আয়তক্ষেত্রের মতো বেতের একটা বড় আর দুটো ছোট সোফা সাজানো। সোফার কুশন কমলা রঙের কভারে ঢাকা। বসার জন্য সোফার পাশে কয়েকটা মোড়া আর সামনে বড় কুশন রয়েছে। মাঝখানে জ্যামিতিক নকশা করা একটা শতরঞ্চি পাতা। সোফা সেটের মাঝখানে একটা বড় কফি টেবিল। সোফাগুলির পাশে ছোট আকারের একই ডিজাইনের সাইড টেবিল। বড় সোফাটার পেছনে দেয়ালের রং অফ হোয়াইট। সেখানে তিনটা ফ্রেমে বাঁধানো পোস্টার টাঙ্গানো। জোয়ান বায়েজ, বব ডিলান, কবির সুমন। সবার হাতে গিটার। পোস্টারগুলোর নিচে মাঝারি আকারের ফ্রেমে বাধা একটা ছবিতে গিটার হাতে একটি মেয়েকে শেজ লাউঞ্জ সোফায় মুখ নিচু করে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে। তার দুদিকে বসে আছে কয়েকজন উপমহাদেশীয় আর শে^তাঙ্গ তরুণী। তাদের পেছনের দেয়ালে ইংরেজিতে ‘ইউনিভার্সিটি অফ বোস্টন’ লেখা। পাশে ফ্রেমে বাঁধা আরেকটা ছবিতে গিটার হাতে একই মেয়েকে দেখা যাচ্ছে শাহবাগের সমাবেশে।
বসবার ঘরের দেয়ালের এক কোণে বেতের দুটো বুককেস। একটা বুককেসের ওপরের শেলফে রবীন্দ্র রচনাবলীর সেট। নিচে বাঁধাই করা নিউ ইয়র্কার, টাইম ম্যাগাজিন। অন্য বুককেসে জীবনানন্দ, শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরীর কবিতার বই। মাঝখানে সৈয়দ শামসুল হকের নাটক সমগ্র। দুই বুককেসের মাঝখানে উঁচু টুলের ওপরে সিরামিক্সের ফুলদানিতে একগুচ্ছ রজনীগন্ধা। কয়েকদিনের বাসি, হলুদ দেখাচ্ছে। সিলিং থেকে ফ্যান ঘুরছে। তার পাখার বাতাসে মাঝে মাঝে ভেজা অ্যানামেল পেইন্টের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
বড় সোফাটার একপাশে পেছনে হেলান দিয়ে বসে তনিমা খন্দকার। তার বয়স বিশের ঘরে ওপরের দিকে। গায়ের রং শ্যামলা। ত্বক একটু রুক্ষ। মুখ ওভাল আকারের। চোখ দুটো বড়, নাক লম্বা আর সরু। কপাল প্রশস্ত, মসৃণ। চুল ছেলেদের মতো ছোট করে ছাঁটা। গলায় সরু চেইন, ইউএস এইডের লোগোর মতো জোড়া হাতের পেন্ডেন্ট।
তনিমা পড়েছে স্টোন ক্রাশ হালকা নীল জিন্স, ওপরে সাদা টপ। পায়ের স্যান্ডেল মেঝেতে রেখে সে দু-পা সোফায় নিয়ে যোগাসনের মতো বসে আছে। তার পাশে সোফার অন্য প্রান্তে একটা অ্যাকোস্টিক গিটার কাত করে রাখা। গিটারের কাছে খোলা নোটবুক আর তার সঙ্গে সুতোয় বাঁধা বলপয়েন্ট কলম। ফ্যানের বাতাসে নোটখাতার পাতা উড়ছে মাঝে মাঝে। অস্পষ্ট খড় খড় শব্দ হচ্ছে তখন।
তনিমার হাতে চায়ের কাপ। সে মাঝে মাঝে চুমুক দিচ্ছে আর কথা বলছে।
তনিমার সঙ্গে কথা বলছে অঞ্জন নামে এক সাংবাদিক। তার পাতলা শরীর, রং ফর্সা, মুখে চাপদাড়ি, চোখে পুরু কাচের চশমা। মুখ দেখে মনে হবে বিশের কিছু ওপরে তার বয়স। কিশোর বয়সের লাজুকভাব চোখে-মুখে। সে পরেছে সাদা পাজামার ওপর গাঢ় সবুজ রঙের পাঞ্জাবি। তার হাতে মোবাইল অন করা। সে তনিমার কথা রেকর্ড করছে। তাকে তনিমার সামনে একটু নার্ভাস দেখাচ্ছে।
তনিমা বলছে, আমি ইন্টারভিউ দিই না। জানেন, কেন দিই না? আমার মনে হয় না ইন্টারভিউ দেওয়ার মতো আমার কোনো অর্জন আছে। তা হলে আপনাকে কেন ইন্টারভিউ দিচ্ছি? আপনি নিশ্চয় এ-কথা ভাবছেন। তা হলে শুনুন। আমি আপনার কোনো প্রশ্নের উত্তর দেব না। আমি সলিলকির মতো, মানে মনোলগে খেয়ালখুশিমতো বলে যাব। পাগল যেমন প্রলাপ বকে, সে রকম অনেকটা। সেটা শুনে আপনি যদি ইন্টারভিউ বলে ছাপাতে চান, ছাপতে পারেন।
তারপর তনিমা নড়েচড়ে বসে বললো, আপনি, আপনার কাগজ, আপনাদের পাঠক নিশ্চয় আমার প্রাইভেট লাইফ নিয়ে জানতে চায়। আমি কী গান করি, কেন গান করি – এসব শোনার বা পড়ার জন্য আপনারা উৎসুক নন। আপনারা, মিডিয়ার সবাই, ছোঁক ছোঁক করে ঘোরেন শিল্পী-সাহিত্যিকদের জীবনে কোনো স্ক্যান্ডাল আছে কি না জানার জন্য। সেটাই মিডিয়ার কাছে বড় নিউজ। পাঠক/ শ্রোতা সেই নিউজ খায়। ‘খায়!’ কী চমৎকার শব্দ বের করেছেন আপনারা।
বলে সে চায়ের কাপে চুমুক দেয়। তারপর হেসে বলে, আপনাদের আমি নিরাশ করবো না। আমার জীবনে স্ক্যান্ডাল দেখতে পাবেন। কিন্তু আমি সেটা স্ক্যান্ডাল মনে করি না। আমার কাছে এটা আধুনিক লাইফস্টাইল। লিভ টুগেদার বিদেশে প্রায় পঞ্চাশ বছর থেকে চালু আছে। এই সম্পর্ককে আইনি স্বীকৃতি দিয়েছে পশ্চিমের প্রায় সব দেশ। ক্যাথলিকপ্রধান দেশগুলো ছাড়া। ক্যাথলিকপ্রধান দেশ কোনগুলো বলেন তো?
অঞ্জন আমতা আমতা করে বলে – স্পেন, ইতালি।
তনিমা বলে, স্পেন ঠিক আছে। কিন্তু ইতালি না। পোপ আর ভ্যাটিকান আছে বলেই ইতালিয়ানরা ক্যাথলিক মেজরিটি হয়ে যায়নি। আয়ারল্যান্ড ক্যাথলিক। লাতিন আমেরিকার প্রায় সব দেশই ক্যাথলিকপ্রধান। ইমাকুলেট কনসেপশন বিশ্বাস করে আর ‘এমেজিং গ্রেস’ গেয়ে মূর্ছা যায়। ওদের সামনে ফ্যামিলি প্ল্যনিংয়ের নাম উচ্চারণ করতে পারবেন না। তাই বলে ভাববেন না আমি তাদের এডমায়ার করি না। অন দি কন্ট্রেরি। আই এডমায়ার দেয়ার আনফ্লিঞ্চিং ফেইথ। হা, কী বলতে যেন ক্যাথিলকরা এসে গেল?
লিভ টুগেদার। অঞ্জন দোহারের মতো ধরিয়ে দেয়।
মনে রেখেছেন? মনে না রেখে পারবেন কেন? শোনার পর থেকেই তো লালা ঝরছে। ইউ আর স্যালিভ্যাটিং। স্ক্যান্ডালের গন্ধ পাচ্ছেন। তাই না? বেশ, শুনুন। আমি বিদেশে পড়ার সময় লিভ টুগেদার করেছি। বড়াই করার জন্য করিনি। সেটা আধুনিক লাইফস্টাইলের অন্যতম বলে করেছি। একটু আগেই করে ফেলেছি। ছাত্রাবস্থায় করাটা ব্যতিক্রমী। সে যাক গে। অনেক বিয়ে যেমন টেকে না, আমার দুই বছরের লিভ টুগেদারও টেকেনি। নাউ আই অ্যাম ইনটু সেভারেল রিলেশনশিপ ইনক্লুডিং সো কল্ড লেসবিয়ান ওয়ান। আমি বুঝলেন, কী যেন নাম আপনার?
অঞ্জন। অঞ্জন চৌধুরী।
হা, অঞ্জন। বুঝলেন আমি লিবারেটেড উয়োম্যান বলতে যা, বোঝায় একেবারে তাই।
অঞ্জন বলে, আপনার গান, মানে কীভাবে গানে এলেন, কে উৎসাহ …।
তনিমা, অঞ্জনকে থামিয়ে বলে, আহ থামেন তো।
আমি প্রথমেই বলেছি স্ট্রাকচার্ড ইন্টারভিউ দেব না। আমার খুশিমতো বলে যাব। তার মধ্যে থেকে আপনি খুঁজে নেবেন, যা আপনার দরকার। লাইক দি গোল্ড ডিগার্স। চালুনিতে অনাবশ্যক জঞ্জাল নিয়ে পানিতে প্যান করবেন। দেখেননি কাউবয় ফিল্মে? কী করে দেখবেন? এখন তো সুপার হিরো আর অ্যাকশন হিরোর যুগ চলছে। আর সাই-ফাই। সিনেমা দেখার মজাটাই চলে গিয়েছে। যাক সে-কথা। আমি বলছিলাম লিবারেটেড উইম্যানের কথা। ভাববেন না, এই আইডিয়া আমি ইউরোপ কিংবা আমেরিকা গিয়ে পেয়েছি। মোটেও না। এই ঢাকাতে বসেই জানতে পেরেছি ভাস্কর নভেরার কথা। ক্যান ইউ ইমাজিন? শি ওয়াজ এ লিবারেটেড উয়োম্যান ইন দি সিক্সটিজ! তখনই তিনি বয়ফ্রেন্ড নিয়ে ঘুরতেন। লিভ টুগেদারও করেছেন বলে শুনেছি।
কথা বলতে বলতে তনিমা পাশে সাইড টেবিলে রাখা ফ্লাস্ক থেকে কাপে কফি ঢেলে বললো, কফি চলবে? চাও আছে।
অঞ্জন বললো, আমি চা, কফি খাই না। ধন্যবাদ।
ও, আপনার কোনো মাইনর ভাইসেস নেই? তনিমা হাসলো। তারপর অঞ্জনের দিকে তাকিয়ে বললো, লজ্জা পেলেন মনে হচ্ছে। আরে না। ঠাট্টা করে বললাম। প্রবাদের মতো কথাটাই ইংরেজ-ভাষাভাষীদের কাছে ঠাট্টার। ডোন্ট মাইন্ড।
বলে তনিমা কফির কাপে চুমুক দেয়। তারপর বলে, বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে লিভ টুগেদার করতে গিয়ে সমকামী হয়ে
গেলাম। মানে লেসবিয়ান। একটা থেকে অন্যটায় না। ব্যাপারটায় অমন কোনো সিকোয়েন্স নেই। একেবারেই অ্যাক্সিডেন্টাল। ডারউইন যেমন বলেছেন, একটা জেনাস থেকে অন্য স্পিসিস হয়ে যাওয়া, তেমন ইভুলিউশনারি কিছু না। একেবারেই অ্যাক্সিডেন্টাল। তবে এর পেছনে আমার পার্টনারের হাত ছিল। পলা নামে এক মেয়ে আমাকে গিটার শেখাতে আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে আসতো। সেও বোস্টন ইউতে পড়ে। আমার এক বছরের সিনিয়র। খুব ভালো ছাত্রী, গিটার বাজায়। জোয়ান বায়াজ, বব ডিলান, সব ফোক সিঙ্গারের গান তার মুখস্থ। বব ডিলান অবশ্য তখন আর অ্যাকোস্টিক গিটার বাজান না। ১৯৬৫ সালে নিউপোর্ট ফেস্টিভালে গিয়ে ইলেকট্রিক গিটার ব্যবহার করলেন। লোকে বলে, সেই থেকে জোয়ান বায়াজের সঙ্গে তাঁর ছাড়াছাড়ি। আসলে তাঁদের ছাড়াছাড়ির পেছনে ছিল সেক্সুয়াল জেলাসি। যাক সে-কথা। পলা আমাকে গিটার শেখাতে আসে। ডিনার খায়। তাকে নিয়ে বাইরেও যাই আমরা একসঙ্গে খেতে। কখনো কখনো দেরি হলে সে আমাদের লিভিং রুমে সোফাতেই ঘুমিয়ে রাত কাটিয়ে ডর্মে যেত। একসময় ডিক মানে রিচার্ড, আমার পার্টনার আমাকে সন্দেহ করতে শুরু করলো। ভাবলো, আমি পলার প্রতি শারীরিকভাবে অনুরক্ত হয়ে পড়েছি। শুনে আমার আকাশ থেকে পড়ার অবস্থা। আমার তখন সে-ধরনের সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন ছিল না। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে দীর্ঘ আলাপ হলো। ডিককে বোঝানোর জন্য অনেক চেষ্টা করলাম। কিছুতেই তার সন্দেহ যায় না। সে একসময় বলে বসলো, ইট ইজ আইদার হার অর মি। অর্থাৎ আমাকে আলটিমেটাম দিলো, পলার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে।
তনিমা কাপে চুমুক দিয়ে কফি খেয়ে বললো, এতে আমার ইগো দারুণ শক পেল। আমার আত্মসম্মানে লাগলো। আই রিভোল্টেড। স্পষ্ট ভাষায় বললাম, গিটার শেখা শেষ হওয়ার আগে কিছুতেই পলার সঙ্গে আমার সম্পর্ক বদলানো যাবে না। তারপর ভেবে দেখা যেতে পারে।
একগুঁয়ের মতো ডিক বললো, তাহলে আমাদের একসঙ্গে থাকা যাবে না।
আমি বললাম, থাকার দরকার নেই। সন্দেহ নিয়ে, আস্থাহীন হয়ে একসঙ্গে থাকার মানে হয় না।
বলে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো তনিমা। তারপর মেঝের দিকে তাকিয়ে স্বগতোক্তির মতো বললো, যা সত্যি ছিল না, ডিক সেটাই সত্যি করে তুললো। বলে না, সেলফ ফুলফিলিং প্রফেসি? একেবারে তাই হলো। পলা আর আমি বন্ধুর চেয়েও বেশি ঘনিষ্ঠ হয়ে গেলাম। আমরা লিভ টুগেদার করতে শুরু করলাম। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে বললো, গিটার বাজিয়ে যা কিছু আমার অর্জন সব পলার অবদান। শি ইজ এ ফ্যান্টাস্টিক টিচার।
অঞ্জন দেয়ালে ফ্রেমে বাঁধা ছবিটার দিকে তাকিয়ে বললো, ওই ছবিতে আপনারা দুজন আছেন?
ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে তনিমা বললো, আমি গিটার হাতে বসে। সেকেন্ড ফ্রম রাইট হলো পলা। পলার গ্রাজুয়েশন সেলিব্রেট করছি আমরা।
তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে আগের মতো বসে সে বললো, আমি গ্রাজুয়েশনের আগে দেশে ফিরে এলাম। বাবার অসুখের কথা শুনে। মা নেই, আগেই মারা গিয়েছেন। আমিই একমাত্র সন্তান। অসুখের কথা শুনে না এসে উপায় ছিল না। আসার পর দেড় বছর পার হয়ে গিয়েছে। এখন পর্যন্ত গ্র্যাজুয়েশনের শেষ বছর পুরো করতে ফিরে যাওয়া হলো না। প্রথমে এক মাস হাসপাতালে বাবার চিকিৎসা নিয়ে ব্যস্ত থেকেছি। তারপর তিনি মারা যাওয়ার পর একটা ঘোরের মধ্যে দিন কেটেছে। এক ধরনের ডিপ্রেশন এসে আচ্ছন্ন করেছে আমাকে। তখন আত্মহত্যার কথাও মনে এসেছে। সেই ব্লু পিরিয়ড পার হওয়ার পর বাবার রেখে যাওয়া এই ফ্ল্যাট আর ব্যাংকের টাকার ওয়ারিশান নিয়ে ম্যালা বুরোক্রেটিক ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছি।
বলে তনিমা সোফার অন্য পাশে রাখা গিটারের দিকে তাকিয়ে বলে, সেই মন-খারাপের দিনে আমাকে সঙ্গ দিয়েছে গিটার। গিটার বাজিয়ে গুনগুন করে গান গেয়েছি একলা বসে। কোনো নির্দিষ্ট সময় ছিল না এই গান করার। সকাল, দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা, গভীর রাত, ভোররাত। যখনই মন খারাপ করেছে, গেয়েছি। কখনো বা শুধুই গিটার বাজিয়েছি। সেই সময় একটা ব্যাপার আবিষ্কার করলাম। দুঃখ-শোক প্রকাশের যে-ভাষা, সেটা মাতৃভাষায় হলে যেমন হৃদয়কে স্পর্শ করে, অন্য ভাষার গান ততটা নয়। যেমন ধরেন জাস্টিন টিম্বারলেকের ‘ফাইভ হান্ড্রেড মাইলস’ গানটি। কিংবা তারো আগে পিট সিগারের ‘হোয়ার আর অল দি ফ্লাওয়ার্স গন’। দুটোই খুব করুণ গান। কিন্তু বাংলাদেশে বসে শোকের মুহূর্তে ওসব বিদেশি গান হৃদয়ের কাছাকাছি যায় না। তখন আমি বাংলা ফোক, গণমুখী বা জীবনমুখী গান শুনতে শুরু করলাম। মনের চাহিদা অনুযায়ী কিছু গাইলাম। বলে তনিমা কিছুক্ষণ থামে। একটা বিড়াল ভেতর থেকে ঘরে ঢুকে কিছুক্ষণ অঞ্জনের দিকে তাকিয়ে এক লাফে তনিমার কোলে গিয়ে বসে। তনিমা তার পিঠে মমতা নিয়ে আঙুল বুলায়।
অঞ্জন প্রশ্ন করে, কাদের গান শুনে অনুপ্রাণিত হয়েছেন?
তনিমা মুখ তুলে বলে, কলেজের এক বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করে নামগুলো পেয়েছি। সলিল চৌধুরী, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, শচীন দেববর্মণ। এঁদের আগে যাঁরা ছিলেন, লালন আর অন্য বাউলদের গান। হাছন রাজার গান।
অঞ্জন বলে, সব ক্লাসিক ফোক সিঙ্গার, কম্পোজার।
তনিমা নড়েচড়ে বসে বলে, আপনি দেখি ফোক সং সম্বন্ধে বেশ জানেন। দারুণ একটা মন্তব্য করলেন। ক্লাসিক। সঠিকভাবেই বলেছেন। কিন্তু অতীতেই সন্তুষ্ট হইনি আমি। নিকট অতীত এবং সম্প্রতিকালের ফোক সংগীতও শুনেছি। পশ্চিমবঙ্গের কবীর সুমন, প্রতুল মুখোপাধ্যায়, পূর্ণ দাস বাউল, মহীনের ঘোড়াগুলি ব্যান্ডের গান। বাংলাদেশের রাধারমণ, শাহ আবদুল করিম।
অঞ্জন বলে, বাংলাদেশে এঁদের পর কিন্তু আরেকটা প্রজন্ম এসেছে। জেনারেশন ওয়াই এবং তারপর মিলেনিয়ালস।
তনিমা হেসে বলে, বাহ! আপনি দেখি আমার জ্ঞানের পরীক্ষা নিচ্ছেন। মনে হয় প্রস্তুতি নিয়ে এসেছেন। তবে শুনুন। আমি জেনেছি নতুন প্রজন্মের একঝাঁক গায়ক একা অথবা তাদের ব্যান্ডের মাধ্যমে ফোক সং গেয়েছে এবং এখনো গাইছে। এদের অনেকের মধ্যে এই মুহূর্তে যাদের নাম মনে পড়ছে তারা হলো – মেহরীন, কৃষ্ণকলি, পড়শি, নবনীতা, শিরিন, কনকচাঁপা, ন্যান্সি, কণা, জলের গান ব্যান্ড, রিংকু পাগলা, অর্ণব, শিরোনামহীন, চিরকুট, অর্থহীন – এই সব গায়ক এবং ব্যান্ডের সদস্য।
অঞ্জন বলে, এদের আগে গণমুখী গানের আরেক ঢেউ ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়। সেখানে প্রবীণ-নবীন, দেশি-বিদেশি সবাই ছিল। তাদের গান নিশ্চয় শুনেছেন?
হা। শুনেছি। বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনেছি। শেখ লুতফর রহমান, আবদুল লতিফ, খান আতাউর রহমান, বদরুল হাসান, আপেল মাহমুদ, নয়ীম গওহর, গোবিন্দ হালদার, গাজী মাযহারুল ইসলাম – এই সব গীতিকারের গান আমি পড়েছি। শিল্পীদের গাওয়া তাঁদের গান শুনেছি।
মেয়েদের আন্দোলনের সময়ই কি প্রথম নিজের লেখা গান গাইলেন?
না। তার আগে থেকেই আমি নিজে গান লিখে, সুর দিয়ে গাইতে শুরু করেছি। যত ভালোই হোক, অন্যের লেখা আর সুর দেওয়া গান গেয়ে তৃপ্তি পাচ্ছিলাম না। মনে হচ্ছিল, নিজের অনুভূতি যেন অন্যের কথায় ঠিক প্রকাশ করা যাচ্ছিল না। মানে, পুরোপুরি না। তখন থেকে নিজে গান লিখি, সুর দিই আমি।
তনিমার কথা শেষ হলে একটা ফোন এলো। ইতস্তত করে সে মোবাইল ফোন তুলে স্ক্রিন দেখে ভ্রু কুঁচকালো। তারপর রেখে দিলো। অঞ্জনের দিকে তাকিয়ে বললো, সেভ করা না হলে আমি ফোন ধরি না। নিজের নিরাপত্তার জন্য। আন্দোলনের সময় ফোন তুলে অনেক শাসানি শুনেছি। খুব খারাপ গালিও। একসময় এলো যখন শুধু ফোনে অপরিচিত কারো সঙ্গে কথা বলা বিপজ্জনক হলো না, বাসায় থাকাও। আন্দোলনের শেষদিকে আমি এক-এক দিন ভিন্ন বাড়িতে থেকেছি। আমার মতো আরো অনেকে তাই করেছে।
এই সময় তনিমার কোলের বিড়ালটা ‘মিয়াঁও’ করে শব্দ করলো। তনিমা তার দিকে তাকিয়ে বললো, বেচারি তখন একা থেকেছে এ-বাড়িতে। কাজের বুয়া বলেছে, মিনি রাতে ঘুমাত না। আমার আসার অপেক্ষা করতো। ওইভাবে তার ঘুমানো আর জেগে থাকার সার্কাডিয়ান সাইকেল বদলে গিয়েছে। এখনো মিনি রাতে জেগে থাকে। দিনের আলো দেখা দিলে ঘুমোতে যায়। এই যে সে ভেতর থেকে এলো, তার মানে সকাল থেকে ঘুমিয়ে রাতে জেগে থাকার খেসারত দিয়ে এসেছে সে। শুধু মানুষ না, বিগত আন্দোলন পশু-পাখির জন্যও ট্রমার কারণ হয়েছে।
অঞ্জন মিনির দিকে তাকিয়ে বললো, তাই তো মনে হচ্ছে। তারপর তনিমার দিকে তাকিয়ে বললো, গান গাওয়া চালিয়ে যাচ্ছেন?
চালিয়ে যাচ্ছেন বলতে কী বোঝাতে চাইছেন? আমি প্রফেশনাল গায়ক নই। শখ করে শিখেছি। ফোক সং, প্রটেস্ট সং, আমেরিকার ক্যাম্পাসে এই ঘরানার গান জনপ্রিয়। তাই আমিও ওটাকেই বেছে নিয়েছি। দেশে ফিরে শখ বজায় রাখতে বাংলা ফোক আর গণসংগীত শিখেছি। কোনো টিভি চ্যানেল ডাকলে সেখানে গিয়ে গেয়েছি। বাদ বাকি গান গাওয়া সব ঘরোয়াভাবে ।
নিজের ব্যান্ড …। অঞ্জন কথা শেষ করতে পারে না।
না রে ভাই, ব্যান্ড গড়ায় অনেক ঝামেলা। আমি ওদিকে যাইনি। একাই গাই। সঙ্গে শুধু ওই অ্যাকোস্টিক গিটার।
কী নাম আপনার সোলো গানের প্রোগ্রামের?
কোনো নাম নেই। তারপর তনিমা হেসে বলে, আমার নামেই নাম। যেসব টেলিভিশন চ্যানেল ডাকে গান গাইতে তাদের অনুষ্ঠানের নিজস্ব নাম আছে। আমি সেই অনুষ্ঠানে ‘আজকের শিল্পী’ হিসেবে এপিয়ার করি। এমন অনেকেই করে।
অঞ্জন বলে, আপনার নাম হয়ে গিয়েছে। আপনি বেশ জনপ্রিয়।
শুনে তনিমা বলে, তাজ্জব ব্যাপার। এদেশে মনে হয় জনপ্রিয় হওয়া খুব সোজা। রুটিন ব্যাপার। বিশ্বাস করুন, আমি জনপ্রিয় হওয়ার জন্য কোনো চেষ্টাই করিনি। এ পর্যন্ত কোনো ফেস্টিভালে, বড় অনুষ্ঠানে গাইনি।
নারী অধিকার আন্দোলনে রাস্তায় সমাবেশে গেয়েছেন। সেই গান আপনাকে জনপ্রিয় করে তুলেছে। অঞ্জন গিটারের দিকে তাকিয়ে বলে।
তনিমা বলে, হ্যাঁ, তাই তো মনে হচ্ছে। অথচ আমি কিন্তু প্রথমে রাস্তায় মেয়েদের সমাবেশে গিয়ে গাইতে রাজি হইনি। রিজিয়া আপু প্রায় জোর করে নিয়ে গেলেন।
রিজিয়া আপু কে? অঞ্জন কৌতূহলী হয়ে তনিমার দিকে তাকিয়ে থাকলো।
তনিমা কিছু বলার আগে ফোন বাজলো। তনিমা ফোন তুলে নম্বর দেখে মুখ নিচু করে রেখেই স্বগতোক্তির মতো বললো, আগের সেই অপরিচিত নম্বর। বারবার করছে কেন? কী চায়? এতদিন পর কি আবার শাসাবে কিংবা অশ্লীল কিছু বলবে? দেখা যাক। বলে সে খুব গম্ভীর হয়ে ফোনের ওপর মুখ রেখে বললো, হ্যালো কে বলছেন? কাকে চাই?
কিছুক্ষণ শুনে সে বললো, হ্যাঁ আমি তনিমা বলছি। কিন্তু আমি তো ভাই আর ওভাবে কোথাও যাব না। আমার বিদেশ যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত আছি।
এরপর সে আবার কিছুক্ষণ ওপাশের কথা শুনলো। শোনার পর বললো, সে তো বুঝলাম। কিন্তু আমার পক্ষে এখন সম্ভব না। সত্যি বলতে কী খুব টায়ার্ড হয়ে পড়েছি। অন্য আরো আছেন। তাদের বলুন। তাহলেই তো হয়।
এরপর আবার কিছুক্ষণ ওপাশের কথা শোনে তনিমা। কখনো সায় দিয়ে মাথা নাড়ে, একমত হতে না পারলে মাথা ঝাঁকায়। তারপর বলে, সবই তো বুঝলাম। কিন্তু আমার যে যাওয়া সম্ভব না। সময় নেই, তাছাড়া মানসিকভাবে আমি একেবারেই প্রস্তুত না। আমাকে আর অনুরোধ করে বিব্রত করবেন না। কী বললেন, ভেবে দেখবো? আপনারা অপেক্ষায় থাকবেন? না না, অপেক্ষায় থাকলে হবে না। আর আমার ভেবে দেখার কিছু নেই। অনেক ধন্যবাদ।
ফোনে কথা বলা শেষ করে তনিমা অঞ্জনের দিকে তাকিয়ে বললো, শুনলেন তো? খ্যাতির বিড়ম্বনা। নারীদের নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। তার প্রতিবাদে আগামী শুক্রবার শাহবাগে সমাবেশ করবে নারীবাদী কয়েকটি দল। আমাকে গান গাইতে বলছেন তারা। শুনলেন তো আমি কী বললাম?
অঞ্জন বললো, ফোন আসার আগে আপনি রিজিয়া আপুর কথা বলছিলেন যিনি ছয় মাস আগে আপনাকে নারী অধিকার আন্দোলনের সমাবেশে প্রায় জোর করে গান গাইতে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি কে?
রিজিয়া আপু এক এনজিওর চেয়ারম্যান। নারী অধিকার নিয়ে তাঁর অনেক কর্মসূচি আছে। আমার দূরসম্পর্কের আত্মীয়।
দুই
একই বসবার ঘর। একই আসবাব, পর্দা। সময় সন্ধ্যা। বাইরের ঘর অন্ধকার হয়ে আছে। শুধু জানালা দিয়ে রাস্তার আলো দেখা যাচ্ছে। কয়েকবার কলিং বেল বেজে উঠলো। ভেতরের ঘর থেকে তনিমা বসবার ঘরে ঢুকে সুইচ টিপে দেয়াল আর সিলিংয়ের বাতি জ্বেলে দিলো। তার গায়ে লাল রঙের কার্ডিগান। গলায় হলুদ মাফলার। হাতে কফির কাপ। কাপ সেন্টার টেবিলে রেখে সে পিপিং হোল দিয়ে দেখে দরজা খুলে দিলো। ভেতরে এলেন এক মহিলা। মাথায় সাদা পাকা চুল, চোখে চশমা। চেহারা দেখে মনে হয় চল্লিশের ঘরে বয়স হবে। হালকা কমলা রঙের তাঁতের শাড়ি পরেছেন। গায়ে সাদা শাল জড়ানো। পায়ে স্যান্ডেল।
তাকে দেখে তনিমা বললো, রিজি আপু হঠাৎ সন্ধ্যায়? বলেননি তো আসবেন?
রিজিয়া খাতুন সোফার দিকে যেতে যেতে বললেন, তোমাকে ফোনে পেলাম না। কয়েকবার করেছি। ফোন ধরো না কেন? এখন নিশ্চয় আর অ্যানোনিমাস কল আসে না।
তনিমা লজ্জিত হয়ে বলে, সেজন্য না। ফোনটা চার্জারে ছিল। শুনতে পাইনি। সরি।
রিজিয়া বেগম বসে বললেন, চা, কফি কিছু দিতে বলো। যা শীত পড়েছে।
সোফায় বসার পর তিনি জানালার দিকে তাকিয়ে বললেন, রাস্তার নয়েজ আসে ঘরে। জানালাটা বন্ধ করে রাখলে কি হয়?
ঘরটা গুমোট হয়ে যায়। নয়েজে আমার কিছু হয় না। অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। তনিমা বলে।
হ্যাঁ। সেটা হয়। সবাই খাপ খাইয়ে নেয়। তা তোমার কাজের কদ্দূর কী হলো?
কাজ? আমার কোন কাজের কথা বলছেন?
আরে ওই যে সাকসেশন সার্টিফিকেট। বাড়ি-জমিজমার মালিকানা হস্তান্তর। যে-কাজের জন্য আমি একজন ল’ইয়ার ঠিক করে দিলাম।
ও, সেই কাজ। আমি ভাবলাম বুঝি জবের কথা বলছেন।
না, জবের কথা বলবো কেন? তুমি তো বলেইছো পড়াশোনা শেষ করতে আবার বোস্টন যাবে।
জি, কাজ অনেকটা গুছিয়ে এনেছি। ব্যাংকের অ্যাকাউন্টগুলো আমার নামে ট্রান্সফারড হয়েছে। খুব তো বেশি টাকা নেই। লাখ আঠারোর মতো হবে।
মাত্র আঠারো লাখ? তাহলে তুমি পড়ার খরচ মেটাবে কী করে? রিজিয়া জিজ্ঞাসা করেন।
তনিমা বলে, জি আঠারো লাখ। বাবার চিকিৎসায় অনেক টাকা লেগেছে। আমার পড়ার, থাকার জন্য যে টাকা তা আমি অ্যাসিস্ট্যান্টশিপ থেকে পেয়ে যাবো। আমার টিচার এ-বিষয়ে আশ্বস্ত করেছেন। তার সঙ্গে আমার মাঝে মাঝে কথা হয়। তিনি আমার গান খুব পছন্দ করেন। কদিন তাঁর বাসায় ডিনারে ডেকে শুনেছেন। অন্য অতিথিও ছিল। ক্যাম্পাস কমিউনিটি।
তুমি ভালো গাও। আমাকে কয়েকজন বলেছে। আমি নিজে শুনিনি। তারপর রিজিয়া বলেন, তুমি টিভি চ্যানেলেও গাও বলে শুনেছি।
তনিমা হেসে বলে, ঢাকায় এত টিভি চ্যানেল। শিল্পী পায় না, তাই আমাকে ডাকে।
না এভাবে নিজেকে ছোট করবে না। তুমি ভালো গাও, তাই ডাকে। যাঁরা শুনেছেন তাঁরা বলেছেন আমাকে। আপনজন হিসেবে আমি গর্ব বোধ করেছি।
তাদের কথার মধ্যে কাজের বুয়া ঘরে এসে ট্রে থেকে চায়ের আর নাস্তার প্লেট টেবিলে নামিয়ে রাখলো। সাদা বিড়ালটা পায়ে পায়ে এসে টেবিলের দিকে তাকিয়ে থাকলো। রিজিয়া বেগম দেখে বললেন, এটা কি এ-বাসার বিড়াল, না রাস্তার?
তনিমা উঠে কোলে নিয়ে তার জায়গায় বসে বললো, মিনি আমার পোষা। খুব লক্ষ্মী। সারাক্ষণ পাশে থাকে।
রিজিয়া বেগম চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, তোমাকে গান গাইতে হবে।
কোথায়?
আমরা নারী অধিকার নিয়ে আন্দোলন করছি। বিশেষ করে ধর্ষণের বিরুদ্ধে। সব নারীবাদী সংগঠন এক হয়েছি দেশব্যাপী। বিরোধীদলগুলি সমর্থন জানিয়েছে। আগামী শুক্রবার শাহবাগে আমাদের সমাবেশ হবে। সমাবেশে বক্তৃতার পাশাপাশি থাকবে গান। শিল্পীরা গাইতে আসবে। তোমার কথা কয়েকজন বলেছেন আমাকে। তোমার গণজাগরণের গানের খুব প্রশংসা করেছেন তারা। আমি গর্ব করে বলেছি, ও তো আমার আত্মীয়া। শুনে তারা বলেছেন, তনিমাকে আপনি আনুন।
শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার মতো হয় তনিমার। সে আমতা আমতা করে বলে, আমি কোনো বড় অনুষ্ঠানে গান গাইনি। আর এ তো হবে রাস্তায়। অনেক লোক থাকবে। আমি পারবো না আপা।
রিজিয়া বেগম বলেন, পারবে। অন্যেরা পারলে তুমিও পারবে।
আমার অভ্যাস নেই। অন্যদের হয়তো আছে।
একবার সমাবেশে গাইলে তোমারও অভ্যেস হয়ে যাবে। রিজিয়া খাতুন চায়ের কাপ টেবিলে রেখে বলেন। তনিমার কোলে বসা মিনি তার দিকে তাকিয়ে মিয়াঁও শব্দ করে।
তনিমা মাথা নেড়ে বলে, না আপু, আমাকে দিয়ে হবে না।
কেন হবে না? আস্থা পাচ্ছ না? প্রথমবার এমন মনে হয়। আমরা নিজের ক্যাপাসিটি যতক্ষণ না কাজে লাগাই সে-সম্বন্ধে অজ্ঞ থাকি।
না। ক্যাপাসিটির কথা বলছি না। আমি বলছি প্রিন্সিপালের কথা। নীতিগতভাবে আমি বড় কোনো ক্রাউডের সামনে গান করতে চাই না। আই অ্যাম নট অ্যান অ্যাক্টিভিস্ট।
এই সমাবেশ মেয়েদের স্বার্থ রক্ষার জন্য হচ্ছে। তুমি মেয়ে হয়ে এর প্রতি সমর্থন জানাবে না?
তনিমা অপ্রস্তুত হওয়ার ভঙ্গিতে বলে, অবশ্যই সমর্থন করি। কিন্তু সমাবেশে গিয়ে গান গাইতে পারবো না।
রিজিয়া বলেন, তা হলে তুমি যে সমর্থন করো সেটা মুখের কথা হয়ে গেল, কাজের বেলা না। লিপ সার্ভিস কথাটা খুব সম্মানজনক না।
শুনে চাবুকের আঘাত পেল যেন তনিমা। রিজিয়া আপু এমন কঠিন ভাষায় কথাটা বলবেন ভাবতে পারেনি সে। শোনার পর বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো সে।
রিজিয়া তার নত মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, সবার কাছে আমার মুখ থাকলো না। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, অগত্যা মিথ্যা কথা বলতে হবে আমাকে। বলবো তনিমা অসুস্থ। হ্যাঁ, এ-কথা বলেই লজ্জা ঢাকবো আমি।
তনিমা মুখ তুলে বললো, আপনাকে মিথ্যা বলতে হবে না। আমি গান গাইতে যাবো।
বিড়ালটা তনিমার কোল থেকে লাফ দিয়ে নেমে এক দৃষ্টিতে রিজিয়া খাতুনের দিকে তাকিয়ে থাকল।
তিন
শুক্রবার বিকেলে শাহবাগে কয়েক হাজার মানুষ জড়ো হয়েছে। মেয়ে আর পুরুষ ছাড়াও বেশ কিছু হিজড়া। টোকাইরা এসেছে দলবেঁধে। সমাবেশের ভিড়ের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে হেলমেটপরা পুলিশ, র্যাব। তাদের পেছনে দেখা যাচ্ছে ওয়াটার ক্যাননের গাড়ি। আর আছে লম্বা লাঠি হাতে ছাত্ররা। তনিমা জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলো, এটাই নিয়ম। সরকার সমর্থক ছাত্ররা পুলিশকে সাহায্য করতে আসে। সমাবেশের মানুষদের ছত্রভঙ্গ করতে তারাই মারপিট শুরু করে। একদিকে পুলিশ, ওয়াটার ক্যানন, লাঠি হাতে ছাত্র আর অন্যদিকে নিরস্ত্র মেয়ে আর পুরুষদের সমাবেশ দেখে ভেতরে ভেতরে বেশ উত্তেজনা অনুভব করে তনিমা। যত সময় যায় তার ভেতরের সেই উত্তেজনা বাড়ে। এখানে এসে প্রথমে তার মধ্যে যে বিচ্ছিন্নতাবোধ ছিল, সেই অনুভব চলে গিয়ে একটা সংকল্প, এমনকি আক্রোশ দেখা দিলো তার ভেতর। তার মনে হলো, সে যেন একটা যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হয়েছে। বৈরী যারা তাদের সামনে না, দেখা যাচ্ছে পেছনে। সে শক্ত হাতে গলা থেকে ঝোলানো গিটার চেপে ধরে। এই যুদ্ধে সেটাই তার অস্ত্র।
বক্তৃতা দিলেন মেয়ে এবং পুরুষ নেতারা। স্লোগান উঠলো বক্তৃতার মাঝে। বয়সে যারা নবীন তাদের কণ্ঠেই স্লোগান উঠলো জোরালো হয়ে। অন্যেরা গলা মেলালেন। সমাবেশ শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই মানুষের কণ্ঠস্বরের উত্তেজনায় বদলে গেল পরিবেশ। সেই উত্তেজনায় দূর হয়ে গেল মনের ইতস্তত ভাব। অজানা আশঙ্কার ভয়। বেশ একটা বিপ্লবী ভাব এসে গেল সবার মধ্যে।
তনিমার পালা এলে সে বেপরোয়া ভঙ্গিতে গিটার হাতে দাঁড়ালো মাঝখানে। উদাত্ত কণ্ঠে গাইলো ‘উই শ্যাল ওভারকাম। আমরা করবো জয়।’
তার গান শেষ হতে না হতে পুলিশের টিয়ার গ্যাস শেল এসে পড়লো একের পর এক। গরম রঙিন পানি ছিটানো হলো গাড়ি থেকে। তারপর শুরু হলো লাঠিচার্জ। ছাত্রদের পেটোয়া বাহিনীর সঙ্গে যোগ দিলো পুলিশ।
ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল সমাবেশের মানুষ। কাঁদুনে গ্যাসে জ্বালা করতে থাকা চোখে হাত দিয়ে দৌড় দিলো অনেকে। রাস্তায় পড়ে গেল কেউ কেউ। চিৎকার এবং আর্তনাদে ভারি হয়ে উঠলো বাতাস। সেইসঙ্গে যুক্ত হলো কাঁদুনে গ্যাসের ঝাঁঝালো গন্ধ। লাঠিচার্জে আহত হয়ে রাস্তায় পড়ে কাতরাতে থাকলো মেয়ে এবং পুরুষ। তাদের মধ্যে তনিমাও একজন। তার হাতের গিটারের তার ছিঁড়ে গিয়েছে। সে উপুড় হয়ে শুয়ে গিটার আগলে রাখছে দু-হাত দিয়ে।
চার
শাহবাগ থানার ভেতরে আনা হয়েছে মেয়ে আর পুরুষদের পঁচিশজনকে। তারা সবাই আহত। থানায় ঢোকানোর পর তাদের পেটানো হচ্ছে। সেইসঙ্গে দেওয়া হচ্ছে অকথ্য ভাষায় গালি। মেয়েদের অবলীলায় বলা হচ্ছে বেশ্যা। জাগা কম থাকায় গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে তাদের। একজনকে মারা ঘুষি অন্যজনের গায়ে গিয়ে লাগছে। আর্তনাদ করে উঠছে কেউ কেউ প্রহারের তীব্রতায়। থানার পুলিশ যেন উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। দেখে এমন অবাক হয় তনিমা যে, মনে হয়, সে দুঃস্বপ্ন দেখছে। ইট ক্যান্ট বি ট্রু। আই অ্যাম ডিরেঞ্জড। আই অ্যাম ইমাজিনিং থিংস। সে মনে মনে বলে।
যে পুলিশ তাকে মারতে যাবে সে গিটার দেখে হাত নামায়। জিজ্ঞাসা করে, গিটার বাজাও? তারপর উত্তরের অপেক্ষা না করে বলে, আমার মেয়ে গিটার বাজায়। তোমাকে আমি এখন মারার জন্য হাত তুলবো। সত্যি সত্যি মারবো না। মার দেওয়ার ভঙ্গি করবো। তুমি গায়ের কাছে হাত আসতেই চিৎকার করে উঠবা যেন অন্য পুলিশেরা মনে করে তোমাকে সত্যি পিটাচ্ছি।
অনেক কষ্টের মধ্যেও তনিমার হাসি পায়। সে বলে, তাহলে মার দেওয়ার ভঙ্গি করবেন কেন?
পুলিশ বলে, অর্ডার। আমাদের স্যারের অর্ডার।
তনিমা বলে, তিনি এই অর্ডার দেন কেন?
স্যার অর্ডার পেয়েছেন তার স্যারের কাছ থেকে। এখন কথা বন্ধ করো। আমি মারার জন্য হাত তুলছি। গায়ে পড়ার আগেই তুমি চিল্লাপাল্লা শুরু করে দেবে।
প্রথমবার মিথ্যা আর্তনাদের পর তনিমা বলে, এরপর কী করবেন আমাদের নিয়ে?
কোর্টে চালান দেওয়া হবে।
তারপর?
জামিন পেলে বেরিয়ে আসবে। কেইস চলতে থাকবে।
কতদিন?
ঠিক নাই। এত কথা বলো কেন? তুমি আসামি। থানায় আছো। এত কথা বলো কেন? আমার চাকরি থাকবে না।
তনিমার হাসি পায়। সে হাসে না। তাকে যন্ত্রণায় চিৎকার করতে হয়। না হলে বেচারা এই পুলিশের চাকরি যেতে পারে।
তাদের কোর্টে পাঠানো হলো না। প্রিজনার্স ভ্যানে করে যে দেয়ালঘেরা বাড়িতে নেওয়া হলো সেটা ডিবি অফিস। তাদের জানালাবিহীন ঘরে আটকে রাখা হলো সারা রাত। হাই পাওয়ার বাল্ব জ্বেলে রাখার জন্য ঘুমাতে পারলো না কেউ। তনিমা আর একটি মেয়ে ছিল এক ঘরে। মেয়েটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। লাঠির আঘাতে তার মুখের একদিক ফুলে গিয়েছে। ঠোঁট দিয়ে বের হওয়া রক্ত শুকিয়ে কালচে দেখাচ্ছে। তার কোনো চিকিৎসা দেওয়া হলো না। সে সারা রাত কাতরালো। হাই পাওয়ার বাল্বের আলোয় তার দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করতে পারলো না তনিমা। মাঝে মাঝে পাহারাদার পুলিশ এসে ধমক দিয়ে গেল কাতরানোর জন্য। ব্যঙ্গ করে বললো, রাস্তায় খাড়ায়া সেøাগান দেওনের সময় খেয়াল হয় নাই? মাগি এহন চিল্লায়। তনিমা প্রতিবাদ করে বলে, ভদ্র ভাষায় কথা বলেন। আপনার মা-বোন নাই?
পাহারাদার বন্ধ দরজার সামনে এসে দাঁত কিড়মিড় করে বলে, খবরদার! আমার মা-বইনের কথা কইবি না। তারা কি তোদের মতন বেলাজ, বেহায়া বেশ্যা? মুখ সামলাইয়া কথা কবি।
তার কথা শুনে তনিমা স্তম্ভিত হয়ে যায়। তার তখন শাহবাগ থানায় যে পুলিশ তাকে মারার ভঙ্গি করেছিল তার কথা মনে পড়ে। সব পুলিশ না হলেও আরো কিছু পুলিশ তার মতো হয় না কেন? স্যারের জন্য? স্যারের এই হায়ারার্কিতে কতজন আছে? সবার ওপরে কোন স্যার? কি তার পদবি?
সকালে তনিমাকে নেওয়া হলো এক কর্মকর্তার কাছে। তিনি বিশাল এক টেবিলের ওপাশে বসে আছেন। পেছনে সেলফের ওপর ফ্রেমে বাঁধা তার বিভিন্ন অকেশনের ছবি। কোথাও তিনি ঘোড়ায় চড়ে আছেন। কোথাও প্যারেডে স্যালুট নিচ্ছেন। আবার কোথাও নেহায়েত সিনেমার হিরোর ভঙ্গিতে পোজ দিয়েছেন।
তার পাশে ছোট টেবিলে প্লেটে নানা রকমের খাবার। দেখে তনিমার পেটের ভেতর খিদে চনমনিয়ে উঠলো। কাল বিকেল থেকে সে কিছু খায়নি। সারা রাত এরা অভুক্ত রেখেছে তাদের। এমনকি পানিও খেতে দেয়নি।
পুলিশ কর্মকর্তা তার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, খুব খিদে পেয়েছে? তাই না?
তনিমা সায় দিয়ে মাথা নাড়লো।
পুলিশ কর্মকর্তা পাশের টেবিলের দিকে দেখিয়ে বললেন, অনেক খাবার আনা হয়েছে। সব খেতে পারবে। তার আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। ঠিক ঠিক উত্তর। বুঝলে?
তনিমা বললো, কোন প্রশ্নের উত্তর?
তিনি বললেন, কারা তোমাদের পেছনে?
কারা মানে? তনিমা অবাক হয়ে বলে।
তিনি উত্তেজিত স্বরে বলেন, কারা মানে কোন দল? তোমরা নিজের ইচ্ছায় শাহবাগে যাওনি। তোমাদের নিয়ে আসা হয়েছে। কারা এনেছে বলতে হবে। সত্যি কথা বলো, না হলে শুধু যে খাবার পাবে না, তাই না। অন্য শাস্তিও আছে। ভয়ংকর শাস্তি।
তনিমা দেখে কর্মকর্তার চেহারা বদলে গিয়েছে। তাকে বন্য জন্তুর মতো হিংস্র দেখাচ্ছে।
সে বললো, ‘নারী অধিকার’ বলে এক সংগঠনের আমন্ত্রণে আমি গিয়েছি। অন্যদের কথা বলতে পারবো না।
নারী অধিকার ফ্রন্ট অর্গাইনাইজেশন। তার পেছনে কোন দল আছে?
আমার জানা নেই। তনিমা মাথা নাড়ে।
মিথ্যা কথা বলছো তুমি। এর পরিণাম ভালো হবে না। এখনো সময় আছে, সত্য কথা বলো। না হলে খুব খারাপ হবে। খুব খারাপ।
বলতে বলতে তার চোখ-মুখ লাল হয়ে যায়।
যা সত্যি আমি তাই বলেছি। এর বেশি কিছু আমার জানা নাই।
জানা নেই! দাঁতে দাঁত ঘষে চিবিয়ে চিবিয়ে কথাগুলি বলে তিনি উঠে দাঁড়ান। টেবিলে রাখা কাঠের স্টিক তুলে তার দিকে এগিয়ে আসেন।
তনিমা ভয়ে চোখ বোজে ॥
এই সময় এক সেপাই দৌড়ে ঘরে ঢোকে। উত্তেজিত স্বরে বলে, স্যার সব মন্ত্রী বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।
কর্মকর্তা দাঁড়িয়ে যান। সেপাইকে হুংকার দিয়ে বলেন, কী যা-তা বলছো? কে খবর দিয়েছে?
কেউ না, স্যার। আমাদের অফিসের সামনের রাস্তা দিয়ে যেতে দেখা যাচ্ছে তাদের।
হয়তো মিটিংয়ে যাচ্ছেন।
না স্যার, পালিয়ে যাচ্ছেন। সবাই তাই বলছে।
কী বলছো তুমি? মন্ত্রীরা পালানো মানে সরকার পতন। কতগুলো মেয়ে দেশের কয়েকটা শহরে মিছিল, অবরোধ করলো আর তাতেই সরকার পড়ে যাবে? তাই হয়? কী বলছো তুমি? মাথা খারাপ হয়েছে?
তার কথা শেষ হতে না হতে আরো কয়েকজন ঘরে এসে ঢোকে। তাদের খুব উত্তেজিত দেখায়।
তারা সমস্বরে বলে, স্যার সরকার নেই। পতন হয়েছে। এখন আমরা কী করবো?
কর্মকর্তা চেয়ারে বসে সামনে বসে থাকা তনিমাকে দেখিয়ে বলেন, একে নিয়ে যাও। আমি হেড কোয়ার্টার্সে ফোন করে দেখছি কী হয়েছে। গুজবও হতে পারে। ওপরের অর্ডার ছাড়া আমরা কেউ কিছু করবো না। ডিসিপ্লিন মেনে চলো। আমাদের শক্তিই হলো ডিসিপ্লিন।
বলে তিনি ফোনে জরুরি নম্বর টাচ করে অপেক্ষা করলেন।
ছয়
বেল টেপার পর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো তনিমাকে। একটু পর দরজা খুলে এক পাশে দাঁড়ালো কাজের ছেলেটা। তনিমা বসবার ঘরে ঢুকে ছেলেটাকে বললো, খবর দাও আমি এসেছি। আপার সঙ্গে কথা হয়েছে। তিনি জানেন আমি আসবো।
ছেলেটা দরজা বন্ধ করে বললো, তিনি আপনেরে বইতে কইছেন। কী খাইবেন জিগাইতে কইছেন আমারে। চা, না কফি?
তনিমা ইতালিয়ান লেদার মোড়ানো সোফায় বসে পেছনে হেলান দিয়ে বললো, কিছু খাব না। আমি অপেক্ষা করছি।
একটু পর তিনি এলেন। হালকা নীল রঙের ফ্রেঞ্চ শিফন শাড়ি পরেছেন। ম্যাচ করা সিল্কের ব্লাউজ। মুখে প্রসাধনের পুরু প্রলেপ। হাতে গুচ্চির ব্যাগ। ঢুকতেই পারফিউমের গন্ধ ছড়িয়ে পড়লো ঘরে মৃদু হয়ে।
সামনের সোফায় বসে রিজিয়া খাতুন বললেন, খুব জরুরি মনে হচ্ছে। ফোনে বললে না, সামনা-সামনি বলতে চাইলে। বেশ বলো। আমার হাতে অবশ্য বেশি সময় নেই। এজন্য বিকেলে আসতে বলেছিলাম।
তনিমা বললো, আমি বেশি সময় নেব না। আপনি নিশ্চয় জানেন দেশের বিভিন্ন জায়গায় বেশ কয়েকটা নারী হয়রানির শিকার হয়েছে।
রিজিয়া খাতুন বললেন, সোশাল মিডিয়ায় সব অতিরঞ্জিত করে।
তনিমা বললো, সোশাল মিডিয়া না, কয়েকটি নারীবাদী সংগঠন এইসব ঘটনা ডকুমেন্টেড করেছে।
বেশ। কী করতে চায় তারা এখন? তিনি ভ্রু কুঁচকে তাকান।
তারা শাহবাগে সমাবেশ করতে চায়। আমাকে বলেছে আপনাকে রাজি করাতে।
কী বিষয়ে রাজি করাতে?
আপনার নারী অধিকার সংগঠন যেন তাদের এই হয়রানিবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেয়। দেবেন না?
না। দেওয়া ঠিক হবে না।
কেন ঠিক হবে না?
বর্তমান সরকার সবদিকে দৃষ্টি দিচ্ছে। নারীদের প্রতি হয়রানিও সরকার উপেক্ষা করবে না।
তনিমা বলে, তা করবে না। কিন্তু এ নিয়ে সমাবেশের মাধ্যমে বিক্ষোভ করলে সরকার হয়তো বিষয়টা জরুরি ভিত্তিতে নিষ্পত্তি করতে চাইবে।
রিজিয়া খাতুন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, এতে সরকারের ওপর চাপ দেওয়া হবে। সেটা ঠিক হবে না। নতুন সরকার। অনেক সমস্যা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। তাকে নিজের মতো করে কাজ করতে দেওয়া উচিত। তারপর তিনি বললেন, নারীবাদী দলগুলো তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে কেন?
মনে হয় দুই কারণে। প্রথমত আমি আপনাদের আন্দোলনে গান গেয়ে অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবে কিছুটা পরিচিত হয়ে গিয়েছি। দ্বিতীয়ত তারা জানে, আপনি আমার আত্মীয়া। ভেবেছে আমি বললে আপনি তাদের সঙ্গে যোগ দেবেন।
শুনে রিজিয়া খাতুন মাথা নাড়েন। বলেন, আমি সরকারকে বিব্রত করতে চাই না। আমি সহযোগিতা করতে চাই। আমাকে তারা একটা পজিশন পেপার তৈরি করতে বলেছেন। আমি সেই দায়িত্ব নিয়ে সরকারবিরোধী কিছু করতে চাই না। তোমারও ওদের সমাবেশে গিয়ে গান গাওয়া ঠিক হবে না।
তনিমা অবাক হয়ে বলে, কেন ঠিক হবে না?
আমি তোমার জন্যে একটা স্কলারশিপের ব্যবস্থা করছি। তুমি সমাবেশে গান গাইলে স্কলারশিপ পাওয়া কঠিন হবে।
তনিমা অবাক হয়ে রিজিয়া খাতুনের দিকে তাকিয়ে থাকলো। তিনি তার কথা ভোলেননি। এমন মানুষকে কি খুব খারাপ বলা যায়?
ভাবতে ভাবতে সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালো তনিমা। রিজিয়া খাতুন উঠে দরজার দিকে যেতে যেতে বললেন, নিজের ভালো-মন্দের কথা ভাবা খারাপ কিছু না। তুমি ওদের সমাবেশে যাবে কি না ভেবে দেখ।
তনিমা বিদায় নেওয়ার আগে বললো, ভেবে দেখবো।
সাত
তনিমা বসার ঘরে বড় সোফায় পা তুলে বসে নোটখাতায় লিখছে। মিনি পাশে বসে ঘুমানোর ভঙ্গিতে শুয়ে আছে। জানালা দিয়ে ভেতরে আসা রাস্তার কোলাহল বাড়ছে, কমছে। বাতি জ্বেলে দেওয়ায় উজ্বল দেখাচ্ছে ঘরের ভেতরটা।
লিখতে গিয়ে মাঝে মাঝে থেমে যাচ্ছে তনিমা। কিছুক্ষণ কলম চিবুকের নিচে রেখে ভাবে সে। তারপর আবার লেখে। এরকম ভঙ্গিতে কয়েকবার দেখা যাবে তাকে।
একসময় লেখা শেষ হয়। তাকে দেখে তাই মনে হবে। সে পাশ থেকে গিটারটা তুলে কোলের ওপর রেখে তারে আঙুল দিয়ে শব্দ তোলে কয়েকবার। মিনি মাথা উঁচু করে দেখে পাশে সরে বসে। এক দৃষ্টিতে তনিমাকে দেখতে থাকে। তাকে বিরক্ত না, প্রসন্ন দেখায়।
তনিমা নোটখাতা দেখে গাইতে থাকে। প্রথমে গুনগুন করে। তারপর ক্রমে তার স্বর চড়া হয়। একসময় সমস্ত ঘর থর থর করে ওঠে গিটারের প্রবল শব্দে আর তনিমার জোরালো কণ্ঠস্বরে। গাইতে গাইতে তনিমা সোফা থেকে উঠে দাঁড়ায়। সে ওপরের দিকে তাকিয়ে তার লেখা গান গায়। ঘরের দেয়াল, সিলিং প্রতিধ্বনি তোলে। মিনি অবাক হয়ে তাকে দেখে।
কয়েকবার গানটি গায় তনিমা। গান গাওয়া শেষ হলে সে কফি টেবিলে রাখা ব্যাকপ্যাকে গানের খাতা ঢুকিয়ে রাখে। সেইসঙ্গে পানির বোতল, বিস্কিটের প্যাকেট। সাইড টেবিলে রাখা ফার্স্ট এইডের বাক্সটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে সেটাও ভরে নেয় ব্যাকপ্যাকের ভেতরে। তারপর ব্যাগ পিঠে ঝুলিয়ে হাতে গিটার তুলে সে দরজার দিকে যায়। মিনি তার সঙ্গে সঙ্গে আসে। তনিমা মিনিকে তুলে নিয়ে চুমু খায়। তারপর ফিরে গিয়ে বড় সোফায় তাকে শুইয়ে দেয়।
দরজার কাছে যেতে যেতে তনিমা পেছন দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে হাত নাড়ে। মিনি তাকে মাথা উঁচু করে দেখে।
আপনার মতামত লিখুন
Array