আন্দােলন মোকাবিলায় শক্তি প্রয়োগ চলতেই থাকবে?

বিগত প্রতিটি সরকারের সময় এবং প্রায় প্রতিবছর বাংলাদেশে বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষকদের আন্দোলন করতে হয়েছে। একই সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে সব সরকারই কঠোর ছিল। এটা খুবই হতাশাজনক; বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হতে পারল না। বাড়ি ভাড়াসহ বিভিন্ন ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে এমপিওভুক্ত স্কুল-কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীরা জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে রোববার ‘লাগাতার অবস্থান’ কর্মসূচি পালন করছিলেন। পুলিশ লাঠিপেটা ও জলকামান ব্যবহার করে সে কর্মসূচি পণ্ড করে দেয় ।
এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা জাতীয় বেতন স্কেল অনুযায়ী বেতন পান। তারা মূল বেতনের সঙ্গে মাসে ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা পান। বাড়ি ভাড়া ভাতা পান এক হাজার টাকা। বছরে দুটি উৎসব ভাতা পান মূল বেতনের ৫০ শতাংশ হারে। শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণের দাবিতে গত ১৩ আগস্ট জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান নিয়ে সমাবেশ করেন এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা। পরে শিক্ষকদের ১২ সদস্যের প্রতিনিধি দল সচিবালয়ে গিয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা চৌধুরী রফিকুল আবরারের সঙ্গে দেখা করে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের মূল বেতনের কমপক্ষে ২০ শতাংশ বাড়ি ভাড়া দেওয়ার দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু ৫ অক্টোবর জানা গেল, সরকার বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বাড়ি ভাড়া মাত্র ৫০০ টাকা বাড়িয়েছে। এর ফলে শিক্ষকদের বাড়ি ভাড়া ভাতা দাঁড়ায় মাত্র দেড় হাজার টাকা। এই টাকায় কোথায় ভাড়া পাওয়া যায় বাড়ি? একটা ছাপরা ঘরের ভাড়াও তো এখন এর চেয়ে অনেক বেশি। স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষক-কর্মচারীরা এ বাড়ি ভাড়া ভাতা প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। সে অনুসারে রোববার তারা রাজধানীতে সমবেত হয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ তাদের ওপর ন্যক্কারজনক হামলা চালায়।
শিক্ষা একটি ব্যবস্থাপনা, যার সঙ্গে জড়িত শিক্ষার দর্শন, শিক্ষক, শিক্ষা বরাদ্দ, কারিকুলাম, সিলেবাস, পাঠ্যপুস্তক, পাঠ পদ্ধতি, শিক্ষা উপকরণ, বিদ্যালয়ের পরিবেশ; সর্বোপরি শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত বাজেট। কয়েক দশকজুড়ে এগুলো নিয়ে বিস্তর আলাপ-আলোচনা চললেও অগ্রগতি তেমন কিছুই হয়নি। আশা জেগেছিল, গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের আমূল সংস্কার ও বৈষম্য নিরসনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকার উল্লেখযোগ্য কিছু করবে। কিন্তু তারাও আগের ধারায় লাঠিপেটা ও জলকামান ব্যবহার করে শিক্ষকদের আন্দোলনকে অভ্যর্থনা জানাল। অবশ্য গত এক বছরে বিভিন্ন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে বয়কট, মব সন্ত্রাস ইত্যাদির মাধ্যমে যেভাবে প্রায় বিনা বাধায় ডজন ডজন শিক্ষককে হেনস্তা ও পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে, তাতেই শিক্ষকদের আন্দোলন সম্পর্কে এ সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি বোঝা গিয়েছিল। এ রাষ্ট্র কখনও শিক্ষকদের আন্দোলনকে শিক্ষা আন্দোলনের পাঠ হিসেবে গ্রহণ করেনি। সবাইকে ‘ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করা’র ওষুধ প্রয়োগে তাই কোনো সরকারেরই হাত কাঁপেনি।
পাঠ্যপুস্তক নিয়ে যা হচ্ছে, তাতেও এর প্রমাণ মেলে। গত এক বছরে আওয়ামী ভূত তাড়ানোর নামে পাঠ্যপুস্তকের ‘টেক্সট’ পরিবর্তনের নানা আয়োজন দেখা গেছে, যেখানে অতীতের মতোই রাজনীতির রং ছিল স্পষ্ট। প্রথম দফায় টেক্সট বুক সংশোধনের দায়িত্ব একটি কমিটিকে দেওয়া হয়। হেফাজতে ইসলাম কমিটির কিছু সদস্যের ব্যাপারে আপত্তি করলে সে সময়ের শিক্ষা উপদেষ্টা সেই কমিটির ‘অফিসিয়াল’ অস্তিত্বই অস্বীকার করেছিলেন। এ ঘটনার রেশ না কাটতেই ভুঁইফোঁড় সংগঠন ‘স্টুডেন্ট ফর সভরেন্টি’র ঝটিকা আন্দোলনের মুখে পাঠ্যপুস্তক থেকে তুলে নেওয়া হয় গ্রাফিতি। অথচ এ গ্রাফিতি ছিল গণঅভ্যুত্থানের স্মারক; সরকারেরই বহুল উচ্চারিত দায়, দরদ ও বহুত্ববাদের প্রকাশ। সম্প্রতি ঘটেছে আরও অদ্ভুত এক ঘটনা। সরকার প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবই জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের পরিবর্তে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মাধ্যমে মুদ্রণ ও বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছে। যেখানে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ হলো সময়ের দাবি, সেখানে ক্ষমতাকে আরও কেন্দ্রীভূত করা হলো। কোনো প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতার কারণগুলো সামনে না এলে ব্যর্থতা-অনিয়ম-দুর্নীতির ছিদ্র কখনোই বন্ধ হবে না। তাই সেগুলোকে জিইয়ে রেখে এক প্রতিষ্ঠান থেকে আরেক প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব অর্পণ আদতে হাতের পরিবর্তনের বাইরে আর কিছুই নয়।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও কি এখন ঠিকঠাক চলছে? কয়েকদিন আগে উপদেষ্টা মাহফুজ আলম সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা যখন দায়িত্ব নিলাম তখন বিএনপি-জামায়াতের লোকেরা এসে বলল, সব ফেয়ার হতে হবে– ভিসি নিয়োগ হলো দশজন বিএনপির, তিনজন জামায়াতের, অ্যাডমিন কে নেবে সেটা নিয়ে কাড়াকাড়ি হলো। এগুলো আমার চোখের সামনেই হয়েছে।’ উপদেষ্টার এ বক্তব্যের মধ্য দিয়েই আমরা আসলে বুঝতে পারি, এই সময়েও শিক্ষা ব্যবস্থাপনা কীভাবে কাজ করছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য পদ এখন অনেকটাই রাজনৈতিক দলগুলোর ইজারা। আগের সরকারের নাম-গন্ধ থেকে নিজেদের দূরত্বে রাখলেও প্রতিষ্ঠান চালানোর পন্থা হিসেবে পছন্দ আগের সরকারের ‘পরিচালনা পদ্ধতি’। অথচ বলা হয়েছিল, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অতীতের দলীয় নেতৃত্বে পরিচালিত হওয়ার ধারা থেকে বেরিয়ে আসবে। আর সব ক্ষেত্রের মতো শিক্ষাঙ্গনেও এক দল যাবে, আরেক দল আসবে– এটিই যেন অলিখিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কয়েকজন শিক্ষককে এখনও একাডেমিক কার্যক্রম থেকে স্থগিত রাখা হয়েছে। প্রতিশোধের রাজনীতির চাকায় ঘুরছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো।
শিক্ষকদের মেরে-ধরে, লাঠিচার্জ করে, জলকামান ব্যবহার করে আদতে ক্ষতি করা হচ্ছে শিক্ষার। এ বিষয়ে কারও মনোযোগ নেই। পাড়ার মোড়ে মোড়ে বিদ্যালয় কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করলেই শিক্ষার প্রসার ঘটে না। উপযুক্ত বেতন-ভাতা না দিলে যোগ্য শিক্ষক সেখানে আসবেন না। ফলে ইট-কাঠ-পাথরের মূল্যবান ভবন হয়তো গড়া যাবে; সেখানে চটকদার বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীও ভর্তি করা যাবে, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত শিক্ষা মিলবে না।
শিক্ষকদের আন্দোলনের দাবিকে অগ্রাহ্য না করে কান পেতে শুনুন– কোথায় সমস্যা হচ্ছে, কেন হচ্ছে। সেগুলো নিয়ে কথা বলুন। আগের সরকারের জুতা পরে ‘ফ্যাসিস্ট ফ্যাসিস্ট’ বলে লাভ হবে না। ফ্যাসিজম কোনো বস্তু বা ব্যক্তি নয়; এটি আদর্শ, কর্মপদ্ধতি, ব্যবস্থাপনা, কৌশল। সেগুলোকে বদলানো না গেলে বদল হবে না কিছুই।
জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় zobaidanasreen@gmail.com
আপনার মতামত লিখুন
Array