অর্থনীতি কিছুটা মন্থর হলেও এগোচ্ছে
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গৃহীত নানা পদক্ষেপের ফলে দেশের অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছে। জিডিপির প্রবৃদ্ধির হারও বাড়তে শুরু করেছে। দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকা চড়া মূল্যস্ফীতির হার কমছে। ডলারের বিপরীতে বিনিময় হারেও স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছে। এমন পরিস্থিতিতে অর্থনীতি সামনে এগিয়ে যাওয়ারই কথা। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের পালে আরও জোরে হাওয়া লাগার কথা। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে ঝুঁকি তৈরি করেছে আগামী জাতীয় নির্বাচন কেন্দ্র করে দেশের অভ্যন্তরে সৃষ্ট রাজনৈতিক ঘটনাবলি ও ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা। এ দুটি কারণে আগামীতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতি কিছুটা স্তিমিত করে দিতে পারে। এতে শক্তিশালী প্রবৃদ্ধির হার অর্জনের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করতে পারে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে কিছুটা মন্থরতা দেখা দিয়েছে। ফলে প্রবৃদ্ধির হার গত অর্থবছরের মাঝামাঝি দুই প্রান্তিকের তুলনায় শেষ প্রান্তিকে কমেছে। গত অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রবৃদ্ধির হার ছিল একেবারে নিম্নে, অর্থাৎ ৩ শতাংশের ঘরে। অক্টোবর-ডিসেম্বরে তা কিছুটা বেড়ে ৪ শতাংশের ঘরে উঠে আসে। জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধির গতি আরও বেড়ে প্রায় ৫ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। গত এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে তা আবার কমে ৩ দশমিক ৩৫ শতাংশে নেমে যায়। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতার কারণে প্রবৃদ্ধির হার কমেছে। সেবা ও শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধির হার হ্রাস পাওয়ার কারণে এ মন্থরতা দেখা দিয়েছে।
আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। এ লক্ষ্যে সরকার সব ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আসন্ন নির্বাচন নিয়ে মতবিরোধ প্রকট আকার ধারণ করেছে। এতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমেই উত্তেজনাকর হয়ে উঠছে। সংকটের সমাধান না হলে উত্তপ্ত পরিস্থিতি রাজপথে গড়াতে পারে বলেও হুমকি দেওয়া হচ্ছে। আর রাজনীতির কারণে রাজপথ উত্তপ্ত হলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হবে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন বৈশ্বিক পরিস্থিতির সঙ্গে অতিমাত্রায় সম্পর্কিত। কারণ, নানা খাতে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা এবং রপ্তানির কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। পাশাপাশি বৈদেশিক খাতে ভারসাম্য রক্ষায় রেমিট্যান্স বড় ভূমিকা পালন করে। এ কারণে বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে উত্তেজনা তৈরি হলে এ দুটি খাতে সমস্যার সৃষ্টি হয়। এতে আমদানি পণ্যের দাম বেড়ে বা বাধাগ্রস্ত হয়ে যেমন মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, তেমনি রেমিট্যান্স বাধাগ্রস্ত হয়ে ডলার বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টির আশঙ্কা থাকে। এসব কারণে ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত বাড়তি শুল্ক দেশটির বাজারে বাংলাদেশ থেকে পণ্য রপ্তানির সুযোগ তৈরি করেছে। কারণ, প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের শুল্ক কিছু ক্ষেত্রে কম, আবার কিছু ক্ষেত্রে সমপর্যায়ে রয়েছে। বিশেষ করে তৈরি পোশাকের জন্য এ সুযোগ বাড়তে পারে। বাংলাদেশ নিম্নমূল্যের পোশাক রপ্তানি করে, যা এখন প্রতিযোগিতামূলকভাবে সুযোগ তৈরি করেছে।
চড়া মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দীর্ঘ সময় ধরে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করছে। এতে ঋণের সুদের হার বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারের নেওয়া বহুমুখী পদক্ষেপের ফলে এখন মূল্যস্ফীতির হার কমতে শুরু করেছে। বর্তমানে বাজারে পণ্যমূল্য আরও কমছে, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি উপকরণের দামও কমেছে। ফলে আগামীতে এ হার আরও কমতে পারে। এতে করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগামীতে নীতি সুদের হার কমানোর দিকে এগোবে। এ হার কমানোর মাধ্যমে বাজারে ঋণের সুদের হার কমানোর ইঙ্গিত দেওয়া হবে। ঋণের সুদের হার কমতে শুরু করলে দেশে বিনিয়োগ বাড়ার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের গতি বাড়বে। এতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আরও ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশাবাদী কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংক সংস্কারের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, ব্যাংক একীভূতকরণ এবং অধিগ্রহণসহ চলমান ব্যাংক খাতের সংস্কারগুলো এ খাতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে শক্তিশালী করতে সহায়তা করবে। তবে ব্যাংক খাতে মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণ এ খাতটির দুর্বলতাগুলো তুলে ধরছে। সরকারের আর্থিক চাপ কমাতে উন্নয়ন ব্যয় আংশিকভাবে হ্রাস করার পাশাপাশি রাজস্ব আদায় জোরদার করার জন্য সরকার অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে প্রতিবেদনে এটিও বলা হয়েছে, আগের দুর্বলতাগুলো মোকাবিলা করে বাংলাদেশের অর্থনীতির সামগ্রিকভাবে সন্তোষজনকভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জগুলো অতিক্রম করেছে এবং স্থিতিশীল জিডিপি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন করেছে। কিছু খাতে যেসব সমস্যা রয়েছে সেগুলো আগামীতে মোকাবিলা করার জন্য নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুকে (ডিসেম্বর, ২০২৫) বলা হয়েছে, চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সংস্থাটির আগের পূর্বাভাসের চেয়ে কম হবে। গত সেপ্টেম্বরে এডিবির একই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ছিল ৫ শতাংশ। ডিসেম্বরে এর চেয়ে কমবে বলে তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এডিবির প্রতিবেদনে সংশোধিত পূর্বাভাস কত শতাংশ, তার উল্লেখ নেই। এ বিষয়ে সংস্থাটির জনসংযোগ বিভাগে যোগাযোগ করে জানা যায়, বাংলাদেশের জন্য চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ধরা হয়েছে ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুকের মূল প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় এপ্রিল মাসে, যেখানে সব দেশের অর্থনীতির বর্তমান ও ভবিষ্যতের ওপর পর্যালোচনা থাকে। ওই প্রতিবেদনে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির অনুমান করা হয়েছিল ৫ দশমিক ১ শতাংশ। এডিবির সংশোধিত পূর্বাভাস যদি বাস্তবের সঙ্গে মিলে যায়, তাহলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি গত অর্থবছরের (২০২৪-২৫) চেয়ে বাড়বে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে গত অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদন-জিডিপির আকার বেড়েছে ৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ।
এডিবির হালনাগাদ প্রতিবেদনে প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমানোর কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, রপ্তানি খাতের ধীরগতিসহ বিশ্বজনীন চাহিদায় দুর্বলতা। রপ্তানি, যা বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বৈশ্বিক চাহিদা কমে যাওয়ার কারণে রপ্তানি উল্লেখযোগ্যভাবে কম বৃদ্ধির দিকে এগোচ্ছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসের মধ্যে শেষের চার মাসে আগের বছরের একই মাসের তুলনায় রপ্তানি কমেছে। জুলাইয়ে বেড়েছিল ভিন্ন কারণে। গত বছর জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাসে রপ্তানি অনেক কম ছিল। এ কারণে চলতি বছর জুলাইয়ে রপ্তানি আয়ের পরিমাণ অনেক বেশি না হলেও দুর্বল ভিত্তির সঙ্গে তুলনার কারণে প্রবৃদ্ধি অনেক বেশি দেখায়। এডিবি বলেছে, বিনিয়োগে অনিশ্চয়তা এবং ব্যাংক ও আর্থিক খাতে দুর্বলতা প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমানোর আরেকটি কারণ। দেশের মোট বিনিয়োগের গতি কমে গেছে। একটি বড় কারণ হিসেবে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও নীতিগত পরিবেশের পরিবর্তনের সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া উৎপাদন ও রপ্তানি কাজে সরবরাহ-শৃঙ্খলা বিঘ্ন ও গ্লোবাল সাপ্লাই চেইন বাধা প্রবৃদ্ধি হ্রাসে বড় ভূমিকা রেখেছে।
এডিবির সাম্প্রতিক পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বাংলাদেশে গড়ে মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশ থাকবে বলে অনুমান করা হয়েছে। পণ্যের দামের ওপর চাপ কিছুটা হালকা হলেও বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় উচ্চ অবস্থায় রয়েছে। শ্রীলঙ্কায় মূল্যস্ফীতি কমে এসেছে। নেপাল বা পাকিস্তানে তুলনামূলক কম দামের চাপ লক্ষ করা গেছে। দক্ষিণ এশিয়ার মোট প্রবৃদ্ধি গতিশীল অবস্থায় আছে। ভারতের বড় অর্থনীতির কারণে পুরো অঞ্চলের গড় প্রবৃদ্ধি ২০২৫ সালের জন্য প্রায় সাড়ে ৬ শতাংশ এবং ২০২৬ সালের জন্য ৬ শতাংশ প্রাক্কলন করা হয়েছে। তবে বড় ভোক্তা বাজার এবং উন্নত প্রযুক্তি-উৎপাদন ক্ষেত্রে পরীক্ষিত সক্ষমতা বাংলাদেশের মতো রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতির তুলনায় অনেক বেশি গতিশীলতা তৈরি করছে। পাকিস্তান, নেপাল বা শ্রীলঙ্কার মতো দেশের তুলনায় বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি কিছুটা বেশি থাকলেও মূল্যস্ফীতি ও বিনিয়োগের পরিস্থিতি তাদের থেকে কিছুটা কঠিন। বাংলাদেশ সরকারের বাজেটে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য মোট প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা রাখা হয়েছিল ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। বাস্তব তথ্যের ভিত্তিতে প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমে আসতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে রেমিট্যান্সপ্রবাহ, ঘরোয়া ভোক্তা ব্যয়, খাদ্য ও সেবা খাতে স্থিতিশীলতা এবং বিশ্ববাজারে কিছু চাহিদা থাকায় আশা করা হচ্ছে পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতি মোকাবিলায় কিছুটা শক্তিশালী হতে পারবে বাংলাদেশ। বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে নীতিগত স্থিতিশীলতা ও রপ্তানি খাতের কাঠামোগত সংস্কার বাস্তবায়িত হলে আগামী বছরগুলোতে প্রবৃদ্ধি বাড়তে পারে।
লেখক: সাবেক কর কমিশনার ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান-ন্যাশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন

আপনার মতামত লিখুন
Array